নোবেল জয়ী সঙ্গীত শিল্পী বব ডিলান তাঁর গানে কবিতার ছন্দে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ কতটা পথ হাটলে, পথিক হওয়া যায়?’ ১৯৬৩ সালে লেখা সেই গানের উত্তর ফুটবলের সাথে মিলিয়ে অবশ্য দেয়া যায়। জবাব দিয়েছেও পেলের দেশের পত্রিকা ‘গ্লোবো’। দীর্ঘ অপেক্ষার পর লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জয়ে ব্রাজিলের পত্রিকাটির শিরোনাম ছিলো, ‘ফুটবল তার দায় শোধ করলো।’ কেন চির প্রতিদ্বন্ধী দেশের পত্রিকাটি মেসিকে সম্মান জানিয়ে এমন শিরোনাম করেছে? যে দেশ ফুটবল খায়, ফুটবলে ঘুমায়, তারা আসলে জানে লিটল জিনিয়াস ফুটবলকে কী দিয়েছে, ফুটবল তাঁর কাছ থেকে কী পেয়েছে। আসলেই, এমন পথিক ছাড়া ফুটবলই তো পথ হারায়, দিক চিহ্নহীন হয়ে যায়-এটা জানা আছে সেলসাওদের। এজন্যই এ কালের ফুটবল ইশ্বর মেসিকে নিয়ে অলটাইম গ্রেট পেলে বলেছেন, ‘ বিশ্বকাপ মেসির প্রাপ্য ছিলো’।
কে যেন বলেছিলো? কারো যদি মন খারাপ থাকে, ক্লান্তি কিংবা চাপ বোধ হয়, তখন মেসির খেলার হাইলাইটস দেখেন। এতে নাকি মহৌষধ আছে। মন ভালো হয়ে যায়। আমি এই দাওয়াই খেয়ে দেখেছি। আসলেই এই ঔষধ কার্যকর, যারা ফুটবল বোঝেন ও ভালোবাসেন তাদের জন্য। যারা কম বোঝেন, মজার জন্য দেখেন তাদের জন্যও মেসির ঐশ্বরিক ফুটবল দক্ষতা সঞ্জীবনি।
ফুটবল গতি, দম ও কৌশলের খেলা। মেসি সেই অভিধানে যোগ করেছেন সৌন্দর্য ও মস্তিস্ক। ন্যানো সেকেন্ডে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সতীর্থকে পাশ দিবেন, ড্রিবলিং করে এগিয়ে যাবেন নাকি গোলে সট নিবেন। এই জায়গায় সে ভিন্ন গ্রহের, এ জন্যই সে ম্যাজিক ম্যান।
ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব ৭ বার জিতে রেকর্ড করেছেন। কোপা আমেরিকা, লাফিনালসিমা, চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, অলিম্পিকে স্বর্ণ, ক্লাব বিশ্বকাপ কী জেতেননি? অধরা বিশ্বকাপও জিতলেন। ৩৫ বছর বয়সেও খেলছেন, শুধু খেলেননি এই বিশ্বকাপে গোল করেছেন ৭টি। করিয়েছেন আরো ৩টি। রেকর্ড দ্বিতীয়বারের মতো হয়েছেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। অথচ তার চীরপ্রতিদ্বন্ধী ৩৭ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এই বিশ্বকাপে নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। বেশিরভাগ সময় বেঞ্চ গরম করেছেন। প্রতিভাবান নেইমার ৩৫ বছর বয়সেও কী এমন সর্বজয়ী হতে পারবেন? কিংবা হালের সেনসেশন ২৪ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পে গতি ও ড্রিবলিং এ কী মাত করতে পারবেন ২০৩৪ কিংবা ৩৮ সালের সালের বিশ্বকাপ?
ব্রিটিশ দৈনিক মিররের ভাষায়, মেসি হলেন গোট ( Greatest of all time-GOAT) ‘সর্বকালের সেরা’। টেলিগ্রাফও একই শিরোনাম করেছে, ‘জি ও এ টি’ (GOAT)। এর কারন তিনি পায়ে বলটা নাচাঁলেও আসলে খেলেন মস্তিস্ক দিয়ে। তাই ৩৫ সেও তিনি ক্লান্ত নন। গতির ঝড়ের চেয়ে তার অলস আর ভয়ংকর মুভই যে পাল্টে দেয় খেলার গতিপথ-এর উদাহরন তো ভুরিভুরি। বিশ্ববাসী আরো একবার তা দেখলো বিশ্বকাপে। যে বিশ্বকাপের ফাইনালকে বলা হচ্ছে স্মরণকালের সেরা।
ফুটবল কতটা হৃদয় নিয়ে খেলে, চাঁপ দেয় তা তো আমরা দেখলাম ফাইনালেই। যেখানে গ্রেট ডি মারিয়ার সুবাদে পেনাল্টিতে মেসির গোল দিয়ে শুরু। এরপর আবার সেই ডি মারিয়া, দ্যা আনসাং হিরো। মেসি-ম্যাক অ্যালিস্টারের দারুন লেনাদেনায় মারিয়ার অনিন্দ্য সুন্দর গোল। ৩৪ মিনিটে দুই গোলে এগিয়ে যায় আলবিসেলেস্তোরা। পিছিয়ে থেকেও ২০১৮ এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের ৭৯ মিনিট পর্যন্ত নরনচড়ন ছিলো না। মনে হচ্ছিলো মাঠে খেলছে শুধু আর্জেন্টিনা। তবে তরুন কিংসলে কোম্যান ও থুরাম জুনিয়র মাঠের নামার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। এমবাপ্পে হয়তো তাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। পেনাল্টিতে গোলের পর ৯৭ সেকেন্ডের মাথায় অসাধারণ ভলিতে গোলের মাধ্যমে কিলিয়ান বুঝিয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যৎ ফুটবলের কিং কে ?
এরপর অতিরিক্ত সময়ের স্নায়ুক্ষয়ী সেইসব মুহুর্ত। মেসির গোলের পর এমবাপ্পের গোল যেন ছিলো নার্ভের চূড়ান্ত পরীক্ষা। প্রশ্ন উঠেই গিয়েছিলো বিশ্বকাপ কী তার দায় শোধ করবে না ? GOAT মেসির চুমুর ছোয়া থেকে কী আবারও বঞ্চিত হবে সোনার কাপটি? এসব দেখে ইশ্বর ম্যারাডোনা হয়তো ওপারে বসে হাসছিলেন। তিনি হয়তো বলছিলেন রেখে যাওয়া ব্যাটনের মান রাখার দায়িত্ব এবার অতি মানব এমি মার্টিনেজের। কী কঠিন মানসিকতা? টাইব্রেকারে ১টি পোনাল্টি ঠেকিয়েছেন। মাইন্ড গেমে আরেকটিতে কুপোকাত করেছেন চুয়ামেনিকে। নার্ভের সেই গেমে ৪ গোল করে পুরো আর্জেন্টিনা টিমই দেখিয়েছে মানসিক দৃঢ়তা। প্রমান করেছেন যে, তারা এবার বিশ্বকাপ জিততেই এসেছিলেন। যে জেতায়, জিতেছে ফুটবল। জিতেছে আন্ডাররেটেড কোচ লিওনেল স্কালোনির কৌশল ও ঠান্ডা মাথার সিদ্ধান্ত।
এজন্যই ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলা হয়ে থাকে ফুটবল বিশ্বকাপকে। এর সুরে-বাশিঁতে সাইবেরিয়া থেকে আলাস্কার মানুষ যেমন এক হয়ে গিয়েছিলো, উত্তর থেকে দক্ষিন মেরুর মানুষেরা হয়েছিলো একাত্ম ।
লেখক যমুনা টেলিভশন এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট