বাসায় কাড়াকাড়ি। টিভিতে সুলতান সুলেমান শেষ হওয়ার আগেই আব্বাকে নামাজের জন্য বাইরে যেতে হয়। ঘরে ফিরেই তার প্রথম জিজ্ঞাসা, কি হল ইব্রাহিম পাশার? শাহজাদা মুস্তফাকে মেরে ফেলল? সুলেমান বুঝল না? হুররাম কি করল? আম্মা বা ভাই-বোনদের উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট নন। সুতরাং, ফের পুনঃপ্রচার দেখ। সময় না মিললে ইউটিউব। নিজে না দেখে যেন তৃপ্তি নেই। কি এমন আছে তুর্কি চরিত্রে? বাংলার ইতিহাসে তুর্কি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং তার বিকাশ নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সেখানে নজরুল আসবে বল্গাহীনভাবে। নজরুল যেভাবে কামাল আতাতুর্ককে, তার দর্শনকে নিয়ে এসেছেন, তারও আগে বিভিন্ন শাসকরা নিয়ে এসেছে তাদের পলিটিকাল ইসলামের ধ্বজা। সেই ধারাবাহিকতা উচ্ছেদ হয়নি, কেন জানি মনে হয় বাঙালির মানসে এখনও তুর্কিদের প্রতি দুনির্বার আকাঙ্খা আছে।তুর্কি মানে কিন্তু কেবল তুরস্ক নয়, আরও বিস্তৃত। ইরান-তুরান পার হয়ে সেই রূপনগরের রাজকন্যার সীমানা একেবারে ছোটও নয়। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এমনকি রাশিয়া অবধি তার সংস্কৃতির বিচরণ। এখন অনেকটা চিমসে এসেছে। কাঁটাতার আর মেট্রপলিটন মনন বাধও সেধেছে। কিন্তু খুব তো বেশিদিন আগে নয়; শতাব্দীকাল আগেও অটোমানরা শাসন করেছে এক-তৃতীয়াংশ দুনিয়া। কেই না বা তাকে বাদ দিয়ে ভাবতে পেরেছে। একদিকে চলেছে ইউরোপের জাতিগুলোর দাস ব্যবসা, উপনিবেশ। কোথাও স্বাধীন ভূ-স্বামীদের আস্তানা। এশিয়ার এমাথা ওমাথায় অটোমানরা। পারসীদের রাজত্ব দমে এসেছে, উপমহাদেশে ঘাঁটি গেড়েছে ব্রিটিশরা; একাংশে জাপ-কোরীয় আর চীনের গ্রেট ওয়াল। সে এক এলাহী কারবার। রাজায়-প্রজায় লড়াই, সীমানায় সংঘাত, তলোয়ারের ফলা, কামানের গোলা আর উদ্ধত বন্দুকের নল। সব মিলিয়ে ইতিহাস যেন বসফোরাসের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে ইস্তাম্বুলের তীরে। কে না তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে? কেউ দেখুক কি না দেখুক, বয়েই গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসের ধুলো ময়লা যত পুরনো হয়েছে জেরুজালেম, ইস্তুাম্বুলের মতো শহরের দীপ্তি যেন তত বেড়েছে। সুতরাং তার সেই রূপ উপেক্ষা করতে আমি অন্তত রাজি নই।
বছর পার হয়ে যাচ্ছে। তবু স্মৃতিতে টাটকা সেসব দিন। যেন পাখায় ভর করে আঙ্কারা-ইস্তাম্বুল চলে আসছে চোখের সামনে। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ। গোথিক রাস্তা। বসফোরাসের শান্ত জলরাশি, হুররমের হাম্মামখানা; ব্লু মস্ক, কামাল আতাতুর্কের প্রমাণ উপস্থিতি, মনোমুগ্ধকর চার্চ কি তোপকাপি প্যালেস। খ্রিস্ট আর মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য সব নিদর্শন; নোনা জলের ভালোবাসাময় গন্ধ। সত্যিই সে এক রূপকথার রাজত্ব।
২.
গিয়েছিলাম আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক কংগ্রেসে। গণতন্ত্র বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদান – প্রদান। এর আগেও এই ফোরামের আরেকটা অনুষ্ঠান হয়েছিল ‘আরব স্প্রিং’ নিয়ে। আর এবারেরটা তুরস্কে ঘটে যাওয়া ‘ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টা’ নিয়ে। যারা বিশ্ব রাজনীতির নানান খুঁটিনাটি নিয়ে আগ্রহী, তাদের কাছে এই বিষয় চুম্বকের মত আকর্ষণীয় হওয়ার কথা; কেননা- মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া আর আফ্রিকার ভুগোল, রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের বাঁক বদলের ক্ষেত্রে অন্যতম ¯্রষ্টা ছিল ২০১৬-র ১৫ জুলাইয়েরবএ ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা।
এরপর থেকেই মার্কিনের সঙ্গে তুরস্কের দূরত্ব বাড়ে, আর রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কানাঘুঁষা শোনা যায়- পুতিন নাকি ফেতুল্লাহ গুলেন আর সিআইয়ের তথ্য হ্যাক করে অভ্যুত্থানের ঘটনা এবং কে কে জড়িত তার তথ্য এরদোয়ানকে দিয়ে তাকে কব্জা করে নিয়েছে। এরপর থেকে সীমান্তঘেঁষ্ধাসঢ়; চির বৈরি দুই দেশের মধ্যে এখন খানিকটা ‘বন্ধুত্বের’ আবহ। ক্যু’র অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে ছিল সেই ফেতুল্লাহ গুলেন কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। তার সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্কও একসময় ভালো ছিল। যে কারণে এরদোয়ানবিরোধীরাও তাকে দেখতে পারে না। সব মিলিয়ে গুলেন তখন তুরস্কের এক নম্বর শত্রু। দেশটির উপরের রাজনৈতিক মহলেও একটাই সুর- জাতীয়তাবাদ। এরদোয়ান সেটাকে কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠলেন আরও প্রভাবশালী। গুলেনপন্থিদের সঙ্গে কুর্দিদের উপরও চালালেন সমানে নিপীড়ন। তার সঙ্গী তারাই- যারা তুর্কি, যারা সুন্নি মুসলিম এবং যারা অবশ্যই এরদোয়ানপন্থি। সাংবাদিক হওয়ার কারণেই প্রোগ্রামে বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত সেশনে অংশ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। ৫টা সেশন, বেশ কয়েকটা সাইড ইভেন্ট; প্রোগ্রামের অন্যতম উদ্যোক্তা জাতিসংঘের মরুকরণবিরোধী কনভেনশনের (ইউএনসিসিডি) আমন্ত্রণ তাই আর ফেলা যায়নি। যদিও ভিসা, টিকেট কনফার্মেশন আর অফিস ছুটি সব মিলেছিল যাওয়ার ঠিক এক-দুইদিন আগে। শেষ পর্যন্ত আমি, উইমেন মুভমেন্টের পক্ষে অনিন্দা সাহা আর ট্রেড ইউনিয়ন থেকে জিয়াউল কবীর খোকন আঙ্কারার উদ্দেশ্যে তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে উঠি ১ মার্চ সকাল (আসলে ভোর) ৭টায়।
৩.
গিয়েই পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য আদতে এরদোয়ানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদার করা। বিশ্বকে দেখানো কেবল তুর্কিরাই নয়, অন্যরাও অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে। তিনদিনের ইনডোর প্রোগ্রাম; নামে অজ অরমানিশ ট্রেড ইউনিয়ন হলেও পুরো কর্মসূচির পেছনে মদদ সরকারি। এমনিতেই প্রভাবশালী সাত্তার আসলান, তার ওপর এ কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতেও সামনে আসার আকাক্সক্ষা স্পষ্ট অজ-অরমানিশের প্রেসিডেন্টের। আঙ্কারায় নেমেই বুঝলাম খালি গুগল করলেই হয় না। খানিক প্রটেকশনও লাগে। কিন্তু আমার কাছে যে পোশাক, তাতে হবে না। অগত্য একটার ওপর আরেকটা। মাঝে একবার খোকন ভাইয়ের কাছ থেকেও শীতের পোশাক ধার নেওয়া। একই ভবনের চার/পাঁচতলায় আমাদের থাকা খাওয়া, আর মাটির নিচের ছয়/সাত তলায় কনফারেন্স। তবে পুরোটাই বস্তাবন্দি অবস্থা ছিল না। উদ্বোধন হয়েছিল শহরের একপ্রান্তে; কনফারেন্সের অংশ হিসেবেই আমরা ভ্রমণ করেছি পার্লামেন্ট ভবন, পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনীর কার্যালয় ও আঙ্কারার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সড়ক। অভ্যুত্থানচেষ্টার সময় এসব স্থানে গোলাগুলি হয়েছে, কোথাও তখনো উপস্থিত গোলার আঘাতের চিহ্ন। ৪৩টি দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। ২২টি দেশের সাংবাদিক, বেশ কয়েকটি দেশের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নারী নেত্রী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদদের নিয়ে হওয়া এই কংগ্রেসের প্রতিটি পর্বেরই সূচনা বক্তব্য দিয়েছেন তুরস্কের একজন মন্ত্রী। এরপর প্রতি পর্বে ছিল প্যানেল আলোচনা। প্যানেল আলোচনাতেই যা কিছু নেয়ার খোরাক ছিল। মিডিয়া সেশনে ছিলেন টিআর টিভির এক নিউজ রিপ্রেজেন্টার। ভদ্রমহিলাকে অস্ত্রের মুখে ক্যুর সংবাদ পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। বলছিলেন, কি ভয়ঙ্কর সময় পার করেছেন সে সময়। এমনকি ক্যু যখন ব্যর্থ হয়ে গেছে, তখনও জানতেন না তা। কারণ, বাইরে কি হচ্ছে সে সম্বন্ধে জানার কোনো উপায় ছিল না তার। তাইতো সকালেও যখন বসফোরাস ব্রিজে সেনাবাহিনীর এক অংশ আত্মসমর্পণ করছে, তখনও তিনি সন্ত্রস্ত কণ্ঠে পড়ে যাচ্ছেন- ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তুরস্কের দায়িত্ব নিয়েছে, বিশ্বাসঘাতকরা পরাজিত হবে।’ ভদ্রমহিলার কথা শুনে মনে পড়ে গেল ইরাকের মন্ত্রী তারিক আজিজের কথা। মার্কিন বাহিনী বাগদাদ বিমানবন্দরও দখল করে ফেলেছে, তারিক আজিজ তখনও বিবিসিকে বলে যাচ্ছেন- ইরাকের এক ইঞ্চি ভূমিতেও মার্কিন বাহিনীর ছায়া নেই।
৪.
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। তাই সবখানেই ছিল আলিশান আয়োজন। একেকবার একেক ঢঙ, একেক পদের খাবার। কমতি নেই কিছুতেই। শুরুটা হালকা মিষ্টান্ন কিংবা স্যুপ দিয়ে, পরে মেইন কোর্স। ওরা যে ভেড়ার মাংসের অনুরক্ত, তাও বোঝা যাচ্ছিল প্রায়ই। তবে সহজে ওদের খাদ্য গলাধকরণ হয় না; কারণ, মশলা আলাদা, আর সঙ্গে অতি অবশ্যই টমেটোর নানান পদ। ওইটা সালাদ না তরকারি, আদৌ খায় কিনা কে জানে। দুপুরে বা রাতে এরকম নানান পদের খাবার, মাঝে মাঝে ভাত, মাছও মিলেছে। তুরস্কের ব্যাপারই এরকম; এমনিতে তো আর ওদের ভোজনের সুখ্যাতি হয়নি। পরে আমরা ইস্তাম্বুলে নেমে তার্কি কাবাবও চেখে দেখেছি। উদ্বোধনের সন্ধ্যাতেই আমাদের জন্য ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। ঐতিহ্যবাহী গান, নাচ সঙ্গে বাদন। অদ্ভুত সুরেলা, এবং মোটেও অপরিচিত নয়। টেলিভিশনে তুর্কি সিরিয়াল কিংবা এগুলো দেখে বা শুনেই সেগুলোকে পরিচিত মনে হচ্ছিল না। দ্বিতীয় গানেই বুঝলাম সুর যে আমার অতি চেনা, এ যে কাজী নজরুলের গানেই শুনেছি। তিনিই যে ওখানকার অনেক সুরের আদল নিয়ে গান বেধেছেন। কথা না বুঝি, ভাবতো বুঝি। গোথিক চার্চের রাস্তায় হিম ঠান্ডায় ফিরে ফিরে আসতেও মনে হচ্ছিল, আহারে কত কাছের এই ধ্বনি, মাথা থেকে সরছিলই না। ওই সাংস্কৃতিক আয়োজনেই সিএনএন তুর্কির এক সাংবাদিকের সঙ্গে ঝগড়া লেগে গেল । সে বলে বসে- তোমরা তো ইসলামিস্টদের ধরে ধরে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছ? মেজাজ সাধারণত এতখানি খারাপ হয় না; খানিকটা উঁচু স্বরেই ওকে জানাতে বাধ্য হলাম- তোমরা যাদের ইসলামিস্ট বলছ, ৭১-এ তাদের একটা রাজাকার বাহিনী ছিল। যারা প্রতিদিন ধরে ধরে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অনুসারীরা এই সেদিনও একের পর এক হত্যা-গুম, নির্যাতন করে ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করেছে। আমার উত্তেজিত স্বর না ভুলভাল ইংরেজি কে জানে, বেটার স্বর নামিয়ে দেয়; নেহাল (সাংবাদিকের নাম) বলে- আমরা তুর্কিরাতো এমনটাই জানি। আমি বলি- তুমি কেমন সাংবাদিক হে, যদি একপক্ষের কথা শুনেই রায় দিয়ে বসো, ওমুক ইসলামিস্ট, তাদের অহেতুক ফাঁসি দেয়া হচ্ছে’। এবার মিনমিনে গলায় সে বলে- দেশে গিয়ে তোমার কথাগুলো আমাকে ভালো করে জানিও তো। মনে মনে বলি- এই যে বাবা লাইনে এসেছো। মুখে বলি- দেশে গিয়েই প্রথম কাজ হবে তোমাকে আইসিটি ট্রাইব্যুনালের লিংক পাঠিয়ে দেওয়া, খেটে খাও বাবা। আর তোমার ইসলামিস্টদের কর্মকা- সম্পর্কে শিউর হও। প্রোগ্রামে ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন লেবার মিনিস্ট্রির অন্যতম এক শীর্ষ ব্যক্তি, ফ্রেঞ্চ এ ভদ্রলোক যেভাবে তুর্কি ক্যুর জন্য জার্মানি আর আমেরিকাকে দায় দিলেন, তাতে আমার ঝুলিতে আরও নতুন কিছু তথ্য যুক্ত হলো। বোঝা গেল- পশ্চিমা বিশ্বে কি বিপুল ওঠানামা চলছে।জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের তখন দা-কুমড়া সম্পর্ক। আমাদের প্রোগ্রামে এক জার্মান সাংবাদিকও এসেছিলেন, এয়ারপোর্টে নামার পরপরই তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক করা হয়। আমিও সাংবাদিক, ভয়ে ভয়ে ইতি উতি তাকাই, কখন না আবার স্পাই বলে বসে? ইউএনসিসিডির এনজিও ও সিভিল সোসাইটি বিষয়ক শীর্ষ প্রতিনিধি মার্কোস এসেছিলেন। তার সঙ্গে রামপাল নিয়ে কথা হলো- বললেন পরের মিটিংয়ে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন তারা। রামপাল নিয়েই কথা হচ্ছিল ইউএনসিসিডির ভারতীয় প্রতিনিধি সত্তরোর্ধ ভবানী শঙ্করের সঙ্গে। সরকারি চাকরি করতেন, সেখানেই ট্রেড ইউনিয়ন করেছিলেন, ছিলেন তার প্রথম সাধারণ সম্পাদক; ইউনিয়নটি কংগ্রেসের হাতে চলে গেলে পদত্যাগও করেছিলেন। সেও ২০ বছর আগে। এখন জৈন ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেন, একটি স্পেশালাইজড চিকিৎসালয়ের ট্রাস্টিও, কাজ করেন ইউএনসিসিডির টেকনিক্যাল এনালিস্ট হিসেবে। বললাম- তোমরা মরুকরণ নিয়ে কাজ করো, অথচ সুন্দরবন নিয়ে কিছু বলছ না কেন? ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। ভবানী স্বীকার করলেন, বললেন এদিকে নজর না দেওয়াটা তাদের ভুল। এ বিষয় নিয়ে তিনি নিজেই নামবেন। রাজস্থানে জন্ম নেওয়া এই ভদ্রলোকের শেখ মুজিব প্রীতিও চোখ এড়ালো না। খানিকক্ষণ বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দলের মৌলবাদপ্রীতি, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ, দুর্নীতি, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী নিয়ে আলাপের পর ছোট করে আনা চোখে আমাকেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, দ্যন হাউ ক্যান এ বাংলাদেশি ডিফার হাসিনা উইথ খালেদা জিয়া?
৫.
একের পর এক সেশন সমাপ্ত হচ্ছিল এরদোয়ান বন্দনায়, আর আমার মেজাজ আরও তিরিক্ষি হচ্ছিল। বেটারা বলে নিয়ে গিয়েছিল মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ইঙ্গিতে, আর গিয়ে দেখি- এই। বলেছিল, আলোচনার সুযোগ মিলবে। গিয়ে দেখি, কিসের কি, নিজেরাই নিজেদের তালি দিতে ব্যস্ত। শেষ দিকে প্রায় বিবাদের উপক্রম। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা আলোচনার ব্যাপারে অটল। সুযোগ মিলল আমারও। প্রথম সুযোগেই শ্রমিকদের আর প্রগতিশীল রাজনীতির ওপর ক্ষমতাসীনদের দমননীতির বেশ কিছু উদাহরণ হাজির করলাম, সংযোগ করলাম স্থানীয় লুটপাটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক; একইসঙ্গে টানলাম পুঁজিবাদের পতনোন্মুখতার নজির। নিস্তরঙ্গ এ সময়কালে আশির্বাদ হয়েই উপস্থিত হলেন আয়শা গোকেন। কনফারেন্স কক্ষ থেকে আমাদের ডেকে নেওয়া হল, তুরস্কের এক পার্লামেন্ট সদস্য আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান বলে। গিয়ে দেখি গোকেন, সঙ্গে আরও এক কুর্দি নেত্রী আর তাদের অনুবাদক। তুরস্কের প্রধান বিরোধীদল এইচডিপির মধ্যেই কাজ করে টিজিপি উইমেন মুভমেন্ট। দলটির সব নারী মেয়র এবং সাংসদ টিজিপির। এই টিজিপি আসলে তার্কিশ কুর্দি নারীদের প্ল্যাটফর্ম। বিভিন্ন জায়গায় তারা নারীর সমানাধিকারের বাস্তব প্রয়োগ করে আসছে। ভাবা যায়, তুর্কির মত একটি দেশে তারা সব ধর্ম-মতের সম্মিলন ঘটিয়েছে। তার্কির কুর্দি পার্টিতেও তাদের অভাবিত প্রভাব। কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এবং যেসব মিউনিসিপ্যাল ও সংসদীয় অঞ্চলে কুর্দিদের নির্বাচিত সদস্যরা আছে সেখানে চলে সামাজিক সাম্যের বাস্তবিক প্রয়োগ। টিজিপির কারণে কুর্দি পার্টি, কুর্দিদের সব ইউনিয়ন এমনকি মিউনিসিপ্যালগুলোতেও দুটি শীর্ষ পদ- চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান। কোনোটাতে পুরুষ থাকলে অন্যটাতে অবশ্যই নারী। আর নারী থাকলে পুরুষ। পুরুষরা যদি কোনো নারীর উপর অত্যাচার করে, তাহলে ওই পুরুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার স্থানীয় টিজিপির। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। পার্টির উপরের স্তরও এই সিদ্ধান্ত বদলের এখতিয়ার রাখে না। কোনো ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে, তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মিউনিসিপ্যালের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়, তার পেনশন চলে যায় স্ত্রীর কাছে। কেউ যদি মেয়েকে স্কুলে না পাঠায়, কর্পোরেশন-মিউনিসিপ্যাল তার বেতনের ২৫ শতাংশ কেটে নিয়ে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এই সিদ্ধান্ত বদলাবে না। যদি কোনো মিউনিসিপ্যাল বা কর্পোরেশন, কিংবা যেসব জোটের অধীনে টিজিপি ও কুর্দি পার্টি কাজ করে, তারা এসব সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ হয়, তাহলে টিজিপি এবং কুর্দি পার্টি তার প্রতিনিধিদের তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে নেয়, মানে পদত্যাগ করায়। নারী মুক্তির ব্যাপারে তাদের বাস্তবিক অবস্থান এতটাই স্বচ্ছ যে, তুরস্কের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম তাদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করছে। যেসব জায়গায় কুর্দি পার্টি বা টিজিপিকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, সেসব স্থানের অত্যাচারিত নারীরাও টিজিপির পক্ষে মার্চ করছে। হাজার হাজার নারী ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চলে আসছে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে। বাড়ছে কুর্দিস্তান আর টিজিপি’র শক্তি। কথাগুলো আমাদের বলছিলেন কুর্দিস্তানের নুজাবিনের নির্বাচিত মেয়র আয়েশা গোকেন। তিনি তার্কিশ পার্লামেন্টেরও নির্বাচিত সদস্য। আমরা গিয়েছি রাজধানীতে, যে অনুষ্ঠানে গিয়েছি তার আয়োজক সরকারপন্থী ইউনিয়ন, আশপাশে গিজগিজ করছে শত শত পুলিশ। অবস্থা এমন যে সেখানে ‘পিকেকে’ কথাটি উচ্চারণ করলেও আশপাশে কয়েকশ কান খাড়া হয়ে যায়। তার মধ্যে আয়েশা এসেছেন, সঙ্গে ছিলেন টিজিপির এক শীর্ষ নারীনেত্রী। আয়েশার কথা যিনি ট্রান্সলেট করছিলেন তিনিও টিজিপির সদস্য, তবে কুর্দি নন, কাজ করেন এইচডিপির ইন্টারন্যাশনাল বিভাগে। তিন নারীর বলা কথা, জ্বলজ্বল করা চোখ আমাকে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’র কথা মনে করিয়ে দিল। কি অদ্ভূত, আমার মনে হচ্ছিল, সত্যিই সামনের দুনিয়া কুর্দি নারীদের, যাদের গেরিলারা আইএসকে তাড়াতে পারে, যাদের লক্ষ্য নারী মুক্তি; এবং সামাজিক সাম্য- তাদের চেয়ে বড় বিপ্লবী এই দুনিয়ায় কারা আছে। এরা কিন্তু নিজেদের মার্ক্সিস্ট বলে না। অথচ তাদের নেতা কে জানেন- আব্দুল্লাহ ওকালান (ওদের
উচ্চারণে ওজালান)। ওকালানের নারী মুক্তির পথ ধরে মানবমুক্তির তত্ত্বের উপরই দাঁড়িয়ে টিজিপি চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সংগ্রাম; কুর্দিস্তান পার্টি চালাচ্ছে সার্বভৌমত্বের লড়াই। একই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আইএসের সাম্প্রদায়িক বিশ্বের স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়েছে সিরিয়ার রোজাভা গেরিলারা, দক্ষিণের কুর্দিরা চাচ্ছে কনফেডারেশন। কি অদ্ভূত- চারপাশে পলিটিক্যাল ইসলামের ফেরি করা সব দেশ; তার ভেতরেও চলছে ওকালানের সমাজতান্ত্রিক কুর্দিস্তান গড়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ফেরি বিশ্বের দেশে দেশে চলে যাচ্ছে আয়েশাদের হাত ধরে। এরদোয়ানও জানেন, এই ওকালানই তার স্বপ্নের পথে বাধা; কুর্দিরাই তার একনম্বর শত্রু। তাইতো বছরকয় আগেও যখন আইএস বোমা হামলা করেছিল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে, তুর্কি জঙ্গি বিমানগুলো ছুটে গেছে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। ষড়যন্ত্র করে গুলেন, তুর্কি ট্যাঙ্ক হামলা চালায় টিজিপির উপর। এরদোয়ান নিশ্চিহ্ন করতে চায় কুর্দিদের; কুর্দিরা চায় অসাম্যকে; বলুন কার জেতা উচিত। দেশে ফিরে যখন নিউজরুমে বসে আইএসের বিরুদ্ধে কুর্দিদের জয়ের খবর অনুবাদ করছি, তখনও যেন উঁকি দিচ্ছিলেন সেই তিন নারী। পরে অন্য এক কারণে অবাকও হয়েছিলাম। তা হল- তাদের সঙ্গে মার্কিনিদের সখ্যতা। স্বাধীন ভুখ-ের কারণেই কিনা কে জানে এমন পক্ষাবলম্বন। জানি না। যাই হোক, নারীমুক্তির সেই তীব্র আকাক্সক্ষা যেন বৃথা না হয়ে যায়।
৬.
কেবল টিজিপি বা উইমেন মুভমেন্টেই নয়, তুরস্কের অলিতে গলিতে দেখা মিলবে নারীদের অদম্য পদচারণা। নারীরা ছুটছে। কামাল আতাতুর্ক বোরখা/হিজাব তুলে দিয়েছিলেন। এখনো সেই রেশ রয়ে গেছে; যদিও ক্ষমতাসীনদের মৌলবাদ প্রচারণাও কম পোক্ত নয়। ধর্মনিরপেক্ষদের ঢাল কামাল আতাতুর্ক; যদিও এ দফা তুরস্কেও অলিতে গলিতে শোনা গেল সুলতান সুলেমানের জন্য হাহাকার। আমাদের জন্য প্রথম দিন যে সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল তাতেও ছিল সুলেমানের জন্য কান্না। বেচারার পরিণতিকে এখনো দুর্ভাগ্যই মনে করে তুর্কিরা। ভুখ- ছোট হলে কি হবে, তার্কিরা ভাবে আবার একদিন তারা দুনিয়ার শাসনভার হাতে তুলে নেবে; রাশিয়া থেকে তুরস্ক,আজারবাইজান, আর্মেনিয়া এমনকি আফগানিস্তান পর্যন্ত তুর্কি সাম্রাজ্যের পতাকাই পতপত করে উড়বে। সে আলোচনা থাক, ওদের ভাত, ওরা পান্তা করে খাওয়ার স্বপ্ন দেখবে, না গাঁজিয়ে, সে তাদের ব্যাপার। ইউরোপের কাছের এই দেশে নাগরিক সুবিধাদিও একেবারে এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। রাতেও আপনি পাবেন সহজ, গতিশীল এবং জনবান্ধব পরিবহন। যেখানেই থাকেন না আপনি, দুই মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন শিশুপার্ক, হাসপাতাল, পার্ক কিংবা বাস-ট্রাম-মেট্রো স্টেশন। ইসলামি দেশ হলে কি হবে? মদ সস্তা। হাঁটলেই মিলবে। তবে সিগারেট কিনতে যেতে হবে অনেকদূর। এ এক ব্যাপার। আঙ্কারায় দেখলাম, ছেলেরা এখানে স্মোকিংয়ে আগ্রহী নয়; অন্যদিকে মেয়েরা ফটাফট ধুম্র উদগীরণ করে যাচ্ছে। হিম বাতাসও প্রকট, তার ওপর পাহাড়ি রাস্তা। পরিস্থিতি এমন, ব্যাপারটাতে মোটেও অস্বস্তি জাগাচ্ছে না। সময় কই কারও, সবাই নিজের রেস নিজে দৌড়াচ্ছে। ৫ তারিখ সকালে নামলাম ইস্তাম্বুল। নেমেই ছুট বাইজেনটাইন, রোম আর অটেমান সাম্রাজ্যের অন্যতম তীর্থভূমি হাগিয়া সোফিয়ায়। টানা ৮ ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালাম বসফোরাস প্রণালী, হায়া সোফিয়া মিউজিয়াম, ব্লু মস্ক আর সিনেমায় দেখে আসা পাথরের বাঁধাই করা রাস্তা। আহা, সে কি অনুভূতি। চোখের সামনে যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল গমগম করা পুরনো জৌলুস। তুলনামূলক সমতল, আর্দ্র আবহাওয়া আর সমুদ্রের কাছে হওয়ায় ইস্তাম্বুল কেন যে তখনকার শাসকদের পছন্দের শহর ছিল সেই সূত্র আবিষ্কারে মত্ত হলাম। ভোরেই দেখলাম ব্লু মস্ক আর এর আশপাশের আঙ্গিনা। এককালে এটি চার্চেরও দখলে ছিল। মুসলিম শাসকরা তার পুরোটা ধ্বংসও করেনি; কিছু অংশ রেখে দিয়েছিল খেরোখাতায়। এ এক অদ্ভ’ত আলিঙ্গন। পরাজিতর ইতিহাসও অমূল্য, অটোমানরা তা বুঝেছিল বোধহয়, বোঝেনি কেবল আমাদের অঞ্চলে দস্যুপণায় মগ্ন শাসকরা। হায়া সোফিয়ার এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত, সবখানেই দুর্দান্ত সব স্থাপত্যের নিদর্শন। ব্লু মস্ক, সুলেমানের প্রাসাদ, তোপকাপি প্যালেস, গ্র্যান্ড বাজার। অলিতে গলিতে বাজারের কমতি নেই। কি নেই সেখানে; সব আছে। ইউরোপীয় আবহাওয়া মনে করে দামাদামি করেননি তো গাছে উঠলেন। অতি অবশ্যই এখানে দরকষাকষি করতে হবে; কে না জানে দোকানদার হিসেবে তুর্কিদের সুখ্যাতি? শেষটা হলো বোট ট্রিপে। দুই ঘণ্টার ভ্রমণ বসফোরাসে। এশিয়া আর ইউরোপের সঙ্গমস্থল ঘুরে দেখলাম। ১২০ মিনিট যেন উড়ে গেল। একের পর এক অসামান্য মসজিদ, কোনোটি সুলেমান আমলের, কোনোটি বানিয়েছেন হুররাম সুলতান, কোনোটি আবার অন্য কোনো শাসক। অন্যপাশে আবার ইউরোপীয় স্থাপত্য, রোমান বড় বড় কলাম। মাথার ওপরে বিশাল বিশাল দুটি সেতু। যেগুলো তুরস্ক হয়ে পৌঁছে গেছে রাশিয়ার ইউরোপ অংশে। সীমান্ত সেতু, পার হতে ৫০ লিরা গোনা লাগে, আমাদের টাকায় হাজারের ওপর। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে ফেরার পথে দেখলাম বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামও; দিনটা রোববার। আর যায় কোথায়, ইস্তাম্বুলবাসী নেমে এসেছে রাস্তায়, সড়কের পাশেই খোলা জায়গায় চলছে দলবেধে রান্না বান্না; পার্কিংয়ে গাড়ি, ছেলে মেয়েরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, চুলা থেকে উড়ছে কাবাব কিংবা মাছ পোড়ানোর ধোঁয়া। ঢাকায় যখন ফিরছি তখনও বিমানের ভেতরে সে আবেশ আর ইতিহাস ছোঁয়ার অনুভূতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। এত এত দূর, তবু এত কাছে।
(২০১৭ সালের লেখা)
লেখকঃ রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক