মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিবস। ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের এই দিন রাস্তায় নামেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা। আর এই শ্রমিকদের ওপর গুলি চলে। এতে ১০ জন নিহত হন। তাদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোট বিশ্বে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি মেনে নেওয়া হয়। সেই থেকে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে আজ নারীর সংখ্যা প্রায় পুরুষদের সমান।
নারীর ক্ষমতায়নের সাথে সাথে নারীরা আজ আর ঘরে বসে নেই । তারা পুরুষদের পাশাপাশি অফিস আদালত করছে। এই অফিস-আদালত করার পাশাপাশি নারীরা প্রকৃতি প্রদত্ত-দায়িত্ব সন্তান জন্মদান ও লালন পালনের কাজটা বাদ দিতে পারছে না । বরং আগের যুগের তুলনায় তাদেরকে সন্তান লালন পালনে অধিক পরিশ্রম করতে হয়। কর্মজীবি মায়েদের জন্য সন্তান লালন পালন করা বেশ কঠিন । আধুনিক জীবন যাত্রায় মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য নারীকে করতে হয় আয় রোজগার অপরদিকে প্রকৃতির দেয়া গুরু-দায়িত্ব পালন করতে হয়। উভয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারীরা ক্লান্ত হয়ে পরছে। অনেক কর্মজীবি মায়েরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরছে। সভ্যতার শুরু থেকে নারীরা স্বাধিনতা বা নিজের মত প্রকাশের আন্দোলন করছে। তারা যা করতে চায় নিজের ইচ্ছের মূল্যায়ন। মানব হিসেবে অন্যের অধীনে থাকা ও অন্যের নির্দেশে কেউ চলতে চায় না। সকলের মত নারীরা সংসারে চায় একটি গনতান্ত্রিক পরিবেশ। এটা মানুষ হিসেবে ন্যায্য অধিকার। অপরদিকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তথা আয় করাও প্রত্যেক মানুষের ন্যায্য অধিকার। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য আয় করা তার মৌলিক চাহিদা। এটা ছাড়া বেচেঁ থাকা তার জন্য দুরুহ ব্যাপার। যে ব্যক্তির নিজস্ব কোন আয় নেই সে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। আপাতঃ দৃষ্টিতে দেখা যায় গ্রামের মহিলারা কোন চাকুরী করছে না। কিন্তু তারা কোন না কোন ভাবে কিছু না কিছু আয় করছে । যেমন, পালানের শাক-সবজ্বির আবাদ, হাসঁ-মুরগি-ছাগল পালন প্রভৃতির মাধ্যমে আয়। হয়তো অধিকাংশ আয় সংসারের মুল খরচে যোগ হচ্ছে না। তবে ঐ আয় ঐ সব মহিলাদের মানসিক নিরাপত্তা বা শান্তির জন্য যথেষ্ঠ। তাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে মায়েদের মানসিক শান্তির জন্য প্রয়োজন কিছু না কিছু আয় করা। কারন মায়ের মানসিক অবস্থা সুস্থ হলে শিশুর বিকাশ সুস্থ হতে বাধ্য। ছোট চারা গাছ বেড়ে উঠার জন্য যেমন আলো, হাওয়া, পানির প্রয়োজন হয় তেমনি কোলের ছোট শিশুর জন্য প্রয়োজন হয় আদর, যত্ন, পুষ্টি, ভালবাসা। ছোট চারা গাছের যেমন প্রতিটি ধাপ বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজন হয় নির্ধারিত পরিমান পরিচর্যা । তেমনি শিশুর জন্য প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত পরিমান যত্ন, ভালবাসা ও পুষ্টি। মায়ের গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে শৈশবকাল পর্যন্ত সকল স্তরে শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজন মায়ের আদর-যত্ন,,ভালবাসা। প্রকৃতি এমন যে, শিশুরা সুধুমাত্র নিজের মায়ের কাছ থেকে সত্যিকার ও নির্ভেজালআদর-যত্ন ভালবাসা পায়। তাইতো কবি গেয়েছিলেন,…. এ জগতে মায়ের মত আপন কেহ নেই.. …. .. । শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন মায়ের সাহচার্য যেখানে সে নিরাপত্তা অনুভবকরে। এই বিষয়টি যে সব মায়েরা অনুভব করে তারা সবচেয়ে বেশি মানসিক যন্ত্রনায় ভোগে। একজন বাবাকে মুলত: অফিসের দায়িত্ব নিয়ে বেশি ব্যাস্ত থাকলেও চলে। কিন্তু একজন কর্মজীবি মাকে একদিকে সন্তান সামাল দেয়া অপরদিকে অফিসের দায়িত্ব পালন করা – দুটোই করতে হয়। দৈত্বভুমিকা পালন করার ফলে দ্রুত মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পরেন। অনেক মা আছেন যারা সন্তানকে সময় দিতে পারছে না বলে অপরাধ বোধে ভোগেন। নিজের মনের আদালতে সে অপরাধি হয়। তাই তারা বাসায় এসে সন্তানকে অবাধ স্বাধিনতা দিয়ে দেন। এই অতিরিক্ত স্বাধিনতা সন্তানের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা দেয়। মায়ের মনোযোগ কম পাওয়ার ফলে কোন কোন শিশু শৈশব পেড়িয়ে কৌশলে এলে অপরাধে জড়িয়ে পরে। এমন সব শিশুর মায়েরা নিজেকে অপরাধি ভাবে। তারা মনে করে চাকুরী করতে এসে তার সন্তানের এই দুরবস্থা হয়েছে। এর জন্য তার কর্মজীবনকে দায়ী করেন। অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, একটি পরিবারে একজনের আয়ে চলে না। আবার দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের মত গরীব দেশে দেশের উন্নয়নের জন্য পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এতে দেশের উন্নয়ন আসতে বাধ্য। আবার নারীর হাত প্রযোজন সুস্থ শিশু বিকাশে। প্রকৃতি নারীর হাতে সুস্থ সন্তান গড়ার দায়িত্ব দিয়েছে। সুস্থ শিশু মানেইতো সুস্থ নাগরিক যারা যে কোন দেশের জন্য অপরিহার্য। তাই একদিকে প্রয়োজন নারী নিজের মৌলিক চাহিদা পুরনের জন্য আয় রোজগার, অপরদিকেনারীর নারী হাত প্রয়োজন ভবিষ্যত প্রজন্মের সুস্থ বিকাশ । এত সব দিকে লক্ষ্য রেখে শিশু বিকাশ গবেষনার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যাংকার মায়েদের জন্য কয়েকটি বটিকা দেয়া হলোঃ
০১. শিশু জন্ম দেয়ার কয়েক বছর আগথেকে প্রত্যেক কর্মজীবি মা-বাবাকে শিশু লালন পালন, বিকাশ, শিশু মনোবিজ্ঞান সমন্ধে জ্ঞান অর্জনকরতে হবে । তাহলে প্রত্যেক মা-বাবা সীমিত সময়ে তার কর্মের পাশাপাশি শিশুর সুস্থ বিকাশনিশ্চিত করতে পারবে।
০২. শিশুর গর্ভকালীন বিকাশ থেকে শুরুকরে শৈশব পর্যন্ত কী কী পুস্টি প্রয়োজন হয় সে সমন্ধে প্রত্যেক বাবা-মাকে যথাযথ জ্ঞান অর্জনকরতে হবে। পাশাপাশি এসব পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চয় করে রাখা যেতে পারে।
০৩. মায়ের গর্ভধারনকাল থেকে শিশুরপ্রাক শৈশব পর্যন্ত কর্ম থেকে ছুটি, অবৈতনিক ছুটি বা সাময়িক অব্যহতি নেয়া যেতে পারে।
০৪. বাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো শিশুর প্রতিটি বিকাশে মা সহযোগিতা করতে পারছে কিনা তা ভালভাবে লক্ষ্য রাখা। শিশুর বাবা তার সন্তানের জন্য হলেও মাকে সহযোগিতা করতে হবে। সবচেয়ে বড় সহযোগিতা হলো মায়ের মানসিক দিকটাতে সার্পোট দেয়া। কর্মজীবি মা যদি কাজ ছেড়ে দিয়ে সুধু সন্তান লালান পালনে ব্যস্ত হলে তার মানসিক অবস্থা খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে মানসিক সার্পোট দেয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতাও বাবাকে করতে হবে। যদি এমনটা হয়, সন্তানের জন্য মা তার চাকুরি বাদ দিয়েছে এই মহত্ব বাবাই একমাত্র অনুধাবন করে তাকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পুরস্কৃত বা সন্মানিত করতে পারেন।
০৫. শিশুরা অনুকরন প্রিয়। অতএব বাবাকে একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে সবসময় শিশুর সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। পেশার অজুহাতে শিশুকে স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
০৬. আমাদের দেশের অধিকাংশই মানুষই কৃষিজীবি । তাই কৃষিজীবি পরিবারের মায়েরা বাড়ীর আসে পাশে শাক-সবজ্বির চাষ, মাছচাষ, মুরগি-গরুর ফার্ম প্রভৃতি করতে পারেন । ফলে সন্তানকে যেমন সময় দেয়া যায় তেমনিনিজের আয় রোজগার বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের উন্ন্য়নে ভুমিকা রাখা যায়।
০৭. কুটির শিল্পের প্রসার বাড়ানো যেতে পারে যা বাড়ীতে বসেই সন্তান পাশে রেখে করা সম্ভব।
০৮. অফিসে যারা কর্মরত আছেন তাদেরজন্য মেটারনিটি ছুটির মেয়াদ ৮-৯ বছর করা যেতে পারে । এতে শিশুর গুরুত্বপুর্ণ বিকাশ কালঅতিক্রম হবার পর মা আবার কর্মে ফিরে আয় রোজগার করতে পারেন। উন্নত দেশে মেটারনিটি ছুটি ৯ বছর । ৯ বছর পর কোন মা কর্মে যোগদান করতে চাইলে কর্মে যোগদান করতে পারে।
০৯. বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়ের প্রতি লক্ষ্যে রেখে বেশ কতগুলো সার্কুলার ইতিমধ্যে জারি করেছে। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
১০. কর্মস্থলে সন্তানকে নিয়ে আসতেপারেন। প্রতিটি কর্মস্থলে শিশুদের জন্য শিশু নিবাস মুলক পার্ক তৈরী করা যেতে পারে। এতে সে একদিকে সন্তানকে নিয়ে টেনশন কম করবে অপরদিকে কর্মে পুরোপুরি মন বসাতে পারবে যা যে কোন অফিসের প্রোডাকশনে ইতিবাচকপ্রভাব ফেলে।
১১. শিশুরা আপন মনে খেলা করে ।কিন্তু তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন হয় মায়ের সাহচার্য। এই ক্ষেত্রে কর্মজীবি মায়েরা অফিসের আংশিক কাজ বাসায় শিশুর দোলনার পাশে বসে করতে পারেন।
১২. কর্মজীবি মাকে যথেষ্ঠ গোছালো হতে হবে। তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত কাজটুকু যথাযথভাবে শেষ করে সন্তানেরকাছে চলে যেতে পারবে। এখানে উলেখ্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ অফিস কর্মকর্তারা ক্রিয়েটিভ কাজ বোঝেন না । তারা মনে করেন যে অফিসার যতক্ষন অফিসে থাকবে সেই ততবেশি কাজ করেছে। অফিস আদালত থেকে এই ধরনের মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে । অফিসের টার্গেট অনুযায়ী কার কি দায়িত্ব তা বছরের শুরুতে লিখিতভাবে তৈরী করা যেতে পারে। যাকে জব ডেসক্রিপশন বলে। ফলে কর্মজীবি মায়েরা তাদের দায়িত্ব নিজ গুনে সময় সুযোগমত দ্রুত শেষ করে সন্তানকে সময় দিতে পারবে।
১৩. মানসিকভাবে অসুস্থ্য অনুভব করলে কাউন্সেলর বা সাইকোথেরাপিস্টের সরনপন্ন হতে পারেন।
মহান মে দিবসে বলতে চাই, আজকের শিশুর আগামি দিনের নাগরিক। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর অর্থ হলো সুস্থ ও স্বাভাবিক জনগোষ্ঠি। সুস্থ জনগোষ্ঠি হলো উন্নয়নের মুল চাবিকাঠি। সুস্থ ওস্বাভাবিক শিশুর জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত ও সুস্থ্য মন-স্বাস্থ্যের মা। অথচ চাকুরীজীবি মায়েরা পুরুষদের পাশাপাশি ৮ ঘন্টা শ্রম দেয়ার পর বাসায় নতুনকরে প্রকৃতির দেয়া চাকুরী করতে হয়। চাকুরীজীবি মায়েদের বিষয়ে মহান মে দিবসের মহান উদ্দেশ্য পুরণ হয় কি?
লেখক- সাইকোথেরাপিস্ট ৃও এডুকেশনিস্ট
সাইকোথেরাপি সর্ভিসেসে, বাংলাদেশ।
হো:আপ- ০১৭৫১-৯২০-৪৫১