আজ থেকে ৭০ বছর আগে এই দিন দেশদ্রোহিতা ও চরবৃত্তির মিথ্যে অভিযোগে পরমাণু বিজ্ঞানী রোজেনবার্গ দম্পতিকে খুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। পরমাণু বিজ্ঞানী জুলিয়াস রোজেনবার্গ এবং তাঁর স্ত্রী এথেল রোজেনবার্গ।
দিনটি, ১৯৫৩ সালের ১৯ জুন। আদালতের আদেশে, নিউ ইয়র্কের হাডসান নদীতীরে সিং সিং কারাগারে, দু’জনকেই ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে খুন করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুপ্তচরবৃত্তি ও দেশদ্রোহিতার , তাঁরা নাকি বীক্ষণাগার থেকে আণবিক বোমা তৈরির গোপন ফর্মুলা সোভিয়েত ইউনিয়নে পাচার করে দিয়েছেন। তখনও পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে অসফল সোভিয়েত রাশিয়া রোজেনবার্গ দম্পতির এই অসাধু কাজে লাভবান হয় বলেও অভিযোগ।
এতদিন মারণাস্ত্রের একচেটিয়া অধিকার নিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়াকে চোখ রাঙিয়ে কাজ হাসিল করেছে। বর্বরতার সঙ্গে বিচূর্ণ করেছে জাপানের দুটো নিরপরাধ শহর, হিরোশিমা ও নাগাসাকি। দ্বিতীয় কোনো রাষ্ট্রের হাতে এই ক্ষেপনাস্ত্রের সম্ভার জমা হলে তাদের সামরিক দাদাগিরি ক্ষুণ্ণ হবে, শক্তির ভারসাম্যে অন্যেরাও ভাগিদার হলে তার দুনিয়াদারির দিন তো শেষ। ঠিক এই সময়েই দুই কোরিয়ার মধ্যে বিবাদ রণক্ষেত্র পর্যন্ত গড়ালে, আমেরিকা ও সোভিয়েত বিবদমান দুপক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে যায়। তটস্থ আমেরিকা ঘোষণা করে একটি গুপ্তচর-জাল তার দেশের গোপন তথ্যাবলী সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দিচ্ছে বলেই রাশিয়ার এত সাহস বেড়েছে।
অতঃপর, আমেরিকা প্রহসনমূলক বিচার পর্ব তাড়াতাড়ি গুটিয়ে নিয়ে দুই বিজ্ঞানীর মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করে দেয়। এতবড়ো একটি অপরাধ, কতো মানুষ এই ‘স্পাই-রিং’-এর সঙ্গে জড়িয়ে, কতো সাক্ষী সাবুদ, পাহাড়প্রমাণ কাগজপত্র — কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, বিসদৃশ তাড়াহুড়োয় মাত্র এক মাস বিচার চলার পরই ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ আমেরিকার ‘এসপিওনাজ অ্যাক্ট’ এর দ্বিতীয় ধারানুযায়ী মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
আমেরিকার পারমাণবিক বোমা-প্রকল্প ‘মানহাটান ডিস্ট্রিক্ট’-এর গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে অনুমান করে প্রথমে ধরা হয় জার্মান কমিউনিস্ট ক্লস ফুক্স’কে। বলা হয়, অর্থলোভে নয়, কমিউনিজমের প্রতি আনুগত্যে তিনি বোমার নকশা পাচার করেছেন মস্কোয়। তাঁর বক্তব্যের ভিত্তিতে ২৮ বছর বয়েসি, কমিউনিজম ভক্ত ডেভিড গ্রিনগ্লাস ও হ্যারি গোল্ডও গ্ৰেপ্তার হয়ে যান। গ্ৰিনগ্লাস সঙ্গে সঙ্গেই রাজসাক্ষী বনে গিয়ে তাঁর দিদি জামাইবাবু, এথেল এবং জুলিয়াস রোজেনবার্গকে অপরাধী বলে ইঙ্গিত করলে তাঁদেরই পাকড়াও করে প্রশাসন। এই দম্পতির সবচেয়ে বড়ো অপরাধ, এঁরা দুজনেই মার্ক্সীয় দর্শনের অনুরক্ত, নিজেদের কমিউনিস্ট বলে মনে করেন। কোনো পাথুরে প্রমাণ ছিল না, রাজসাক্ষীর বক্তব্যকে চূড়ান্ত চিহ্নিত করে গোয়েন্দা প্রধান এডগার হুভার ওঁদের অপরাধকে আখ্যা দিলেন ‘ক্রাইম অফ দি সেঞ্চুরি’ বলে আর প্রসিকিউটর বললেন, “এই দম্পতির আনুগত্য মার্কিন রাষ্ট্রের প্রতি নয়, অন্য কিছুর প্রতি। সেটি হচ্ছে কমিউনিজম।” স্পষ্টতই প্রভাবিত বিচারক ইরভিং কাউফম্যান, কমিউনিস্ট বিজ্ঞানী দম্পতিকে অপরাধী সাব্যস্ত করলেন। এথেল রোজেনবার্গের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রমাণ ছিল না। জুলিয়াস রোজেনবার্গের স্ত্রী হওয়ার অপরাধেই তাঁকে মরতে হলো। তাঁদের কচি কচি দুটি সন্তানকেও অনিশ্চয়তা ও অসম্মানে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। বিজ্ঞানী দম্পতিকে অবশ্য টোপ দেওয়া হয়, চাপও, তাঁরা যদি রাজসাক্ষী হয়ে প্রকৃত অপরাধীদের ধরিয়ে দেন, তাহলে শাস্তি লঘু হবে, তাঁদের জীবন রক্ষা পাবে। উভয়েই দৃঢ়তার সঙ্গে আদালতকে বলেন, এক, তাঁরা এই অপরাধ করেননি এবং দুই, কোনো অবস্থাতাতেই রাজসাক্ষীর হীনতায় তাঁরা নিজেদের নামিয়ে আনবেন না।
নিদারুণ নির্মম ছিল এঁদের হত্যার প্রক্রিয়া। সন্ধে ৮.৪ মিনিট থেকে ৮.৬ মিনিট পর্যন্ত তিন দফায় ২০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ ঝলকের পর জুলিয়াসকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এরপর এথেলকে ৮.১১ থেকে ৮.১৬ মিনিট পর্যন্ত বারবার বিদ্যুৎ প্রয়োগ করতে হয়। কারণ তৃতীয় দফার পরেও তাঁকে হাসতে দেখা যায়। পরের দিনের কাগজে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়।
রোজেনবার্গদের বিচার পর্বের শুরু থেকে মৃত্যু ঘোষণার আগে পর্যন্ত আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের নাগরিক সমাজ ও স্বাধীনতাকামী মানুষ প্রতিবাদে উত্তাল হয়। জ্যাঁ-পল সার্ত্রের মতো বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তি ঘোষণা করেন, যা হচ্ছে তাকে বলে ঠাণ্ডা মাথায় খুন। পোপ দ্বাদশ পিয়াস এই জোড়া হত্যা বন্ধ করতে বললেন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারকে । পাবলো পিকাসো প্রবন্ধ লেখেন, “আমি ঘন্টা, মিনিট গুনছি। মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধ সংঘটিত হতে দেবেন না।” আলবার্ট আইনস্টাইন, ফ্রান্সের ভবিষ্যত রাষ্ট্রপতি চার্লস ডি গল, লেখক টমাস মান, ফ্রাঁসোয়া মারিয়াক, মার্টিন ডু গার্ড রোজেনবার্গদের প্রতি বিবেচনা প্রদর্শনের আহ্বান জানালেন। নানা দেশের অসংখ্য রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়ন গোষ্ঠী দাবি করলেন মুক্তির।
সব থেকে করুণ ও মর্মবিদারী ঘটনা, জুলিয়াস এবং এথেল রোজেনবার্গ-এর দুটি কচি কচি সন্তান “আমাদের বাবা এবং মাকে হত্যা করবেন না!” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো।
কিন্তু সকলের সব আবেদন অগ্ৰাহ্য করে আইসেনহাওয়ার তাড়াহুড়োয় তাঁদের প্রাণদণ্ড কার্যকর করে দিলেন।
রোজেনবার্গ কমিটি, ২১ শে জুন ব্রুকলিনের ওয়েলউড সমাধিস্থলে এথেল এবং জুলিয়াস রোজেনবার্গের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান করে। সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের কাছে অনুরোধ আসে দুই গুপ্তচরের শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ না করার জন্যে। সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে অন্তত ৫০০ জন সমাধিস্থলে এবং ১০ হাজার মানুষ অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমাধি উদ্যানের বাইরের রোদ্দুরে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আমাদের দেশেও রোজেনবার্গ দম্পতির মৃত্যুদণ্ডে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত লেখক কৃষণ চন্দর ‘পাপ’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। কারাগারে থাকার সময় জুলিয়াস ও এথেল দম্পতি পরস্পরকে যে সব চিঠি লিখেছিলেন তা সংকলিত হয়ে পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে বাংলায় ‘রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয় ক্যালকাটা বুক ক্লাব লিমিটেড থেকে।
আমেরিকার মানবাধিকার ও স্বাধীনতা হরণের ইতিহাস অনেক পুরনো। বহু দরিদ্র দেশ ও নিরীহ মানুষ এই শক্তিধর দেশের নিষ্ঠুর আগ্ৰাসনে বিধ্বস্ত ও বিড়ম্বিত হয়েছে। রোজেনবার্গ হত্যা তাদের কাছে তাই বিশেষ কোনো ঘটনাই নয়। কিন্তু এই বিজ্ঞানী দম্পতির দণ্ডদান পদ্ধতি ও হত্যার প্রক্রিয়া বিশ্ব জনমত ও বিশ্ব বিবেককে বিচলিত করেছে। যাঁরা একাজ করেছিলেন ইতিহাস তাঁদের মনে রাখেনি, কিন্তু যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁরা আজও মানব স্মৃতিতে স্বমহিমায় বেঁচে রয়েছেন।
আমেরিকাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে পাপবোধ। পরবর্তীকালে খ্রুশ্চভের আত্মজীবনীর অসংলগ্ন অংশ উদ্ধার করে গুপ্তচরচক্র প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে। গুপ্তচর সব দেশেরই আছে, সোভিয়েতেরও ছিল, আমেরিকারও আছে, নতুন কথা কিছু নয়। তাতে রোজেনবার্গদের দোষ প্রমাণ হয় না বরং গ্ৰিনগ্লাস মুক্তি পাওয়ার পর কাগজে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন শুধু বাঁচার জন্যে রোজেনবার্গদের বিরুদ্ধে তিনি মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন, তিনি অনুতপ্ত। তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আমেরিকার কাগজে কাগজে ছাপা হয়েছে।
আজ সেই দিন, ৭০ বছর আগের ইতিহাস বারেবারে ফিরে আসার দিন। আজও ওয়েলউড সমাধি উদ্যানে ফুল হাতে শত শত মানুষ মাথা নত করে দাঁড়াবে রোজেনবার্গ দম্পতির স্মরণে।