সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্ব প্রথম সংবিধান সম্পর্কে মহামতি লেনিন মন্তব্য করেছিলেন যে এ যাবৎ সকল সংবিধানই শাসক শ্রেনীর স্বার্থকে সুরক্ষা প্রদান করেছে। সোভিয়েত সংবিধানই প্রথম কোনো সংবিধান যা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ কে সংহত করতে ভূমিকা রাখবে। সোভিয়েত সংবিধান হবে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা। ১৯৭১ এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান লাভ করে, যা ছিল বাংলা ভাষায় লেখা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রথম কোনো সংবিধান। পাকিস্তান আমলে সংবিধান প্রণয়নে প্রায় নয় বছর লেগে গিয়েছিলো যদিও সেটি আড়াই বছরের বেশি কার্যকর ছিল না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) কিছু পরিবর্তন ও সংশোধনের সুপারিশ সহ বাহাত্তরের সংবিধান কে ইতিবাচক ভাবেই নিয়েছিল। অপরদিকে ন্যাপ (ভাসানী) ও জাসদ সংবিধানের উপর গণভোটের দাবি জানিয়েছিল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ৭২ এর সংবিধান সম্পর্কে এক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমাদের সংবিধানের শব্দ, বাক্যাংশ এবং ধারণাগুলো অন্যান্য দেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল থেকে প্রবল ভাবে ধার করা।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমবারের মতো বাংলায় সংবিধান রচনা ছিল আমাদের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ণ ঘটনা। আধুনিক সাংবিধানিক ধারণাগুলোকে আমাদের আইনি সংস্কৃতির মধ্যে আত্তীকরণ করার ক্ষেত্রে এটি ছিল এক বিরাট পদক্ষেপ।’।
সংবিধান হচ্ছে সেই দলিল যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে উঠে ও পরিচালিত হয়। সাধারণত সরকারের গঠনপ্রণালী, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকে। সরকার পদ্ধতি, আইন প্রণয়ন ও প্রতিপালন পদ্ধতি, বিচারিক প্রক্রিয়া, নির্বাচন পদ্ধতি, সকারের আয় ব্যায়ের পরিচালন পদ্ধতি, ব্যবসা বাণিজ্যের নীতিমালা, সম্পদের মালিকানার ধরণ, অন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নীতিমালা, নাগরিকের সর্বোচ্চ বিকাশে করণীয়, পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক সহ যাবতীয় নির্দেশনা সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। ৭২ এর সংবিধান ১১ টি অধ্যায়, ১৫৩ টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিলে বিভক্ত। সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ে প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকার, চতুর্থ অধ্যায়ে নির্বাহী বিভাগের প্রকৃতি, পঞ্চম অধ্যায়ে আইনসভা (সংসদ), ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিচার বিভাগ, সপ্তম অধ্যায়ে নির্বাচন, অষ্টম অধ্যায়ে মহাহিসাব নিরীক্ষক, নবম অধ্যায়ে বাংলাদেশের কর্ম বিভাগ, দশম অধ্যায়ে সংবিধান সংশোধন এবং একাদশ অধ্যায়ে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। ৭২ এর সংবিধান স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশের মূলনীতি হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। আরো উল্লেখ আছে যে পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত সংসদীয় সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশন, কর্ম কমিশন, ইত্যাদি হবে সাংবিধানিক সংস্থা। মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন বিচার বিভাগ বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। ৭২ এর সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে উল্লেখ আছে মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়পরায়ণ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভের উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা হবে রাষ্ট্রের লক্ষ্য। আরো আছে যে রাষ্ট্রে ধমীয় স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্টিত হবে, রাষ্ট্র মেহনতি কৃষক-শ্রমিকের শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত হবে। জনগণের অন্ন, বস্ত্র,আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকীর্ষা সহ কর্ম, বিশ্রাম ও বিনোদনের অধিকার প্রতিষ্টা করবে রাষ্ট্র। কোনো ব্যাক্তির অনুপার্জিত আয় ভোগ করার সামর্থ থাকবে না। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন দানের বিষয়কে রাষ্ট্র তার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।
এখন পর্যন্ত সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাসক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে সংবিধানে সংশোধন আনে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানে প্রথম থেকে চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতায় থাকাকালে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময়ে সংবিধানে সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংশোধনী আনা হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময়ে একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় । পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ আমলে। ৭২ এর সংবিধানে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল ৭৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই তা সংশোধন করে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান রেখে বিশেষ আইন পাস হয় এবং ডিসেম্বর মাসে মৌলিক অধিকার স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীতে একটি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল কে নিষিদ্ধ করা হয়। শেখ মুজিবর রহমান কে স্বপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক ফরমান বলে সংবিধান থেকে দালাল আইন ১৯৭২ বিলোপ করে দেয়া হয়। যদিও এর আগেই তাদের বিরাট সংখ্যা কে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৬ সালে আরেক ফরমান বলে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্মীয় নামে রাজনৈতিক সংগঠন করার ওপর যে বাধানিষেধ ছিল সে অংশটি বাতিল করে দেয়া হয় এবং স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার সুযোগ করে দেয়া হয়। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ফরমান জারি করে সংবিধানের প্রস্তাবনার উপরে ‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম’ সংযোজন করেন এবং মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের বদলে ‘সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’ যোগ করে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দেন। অষ্টম সংশোধনীতে এরশাদ জিয়াউর রহমানের পথ ধরে ইসলাম কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে সংশোধনী আনেন। এরশাদ পতনের পর একাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারীকে অবৈধ বলা হয় এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য আন্দোলনকারীদের বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বললেও কার্যত তা হয়ে দাঁড়ায় প্রধানমন্ত্রী শাসিত কেননা এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর হাতে একছত্র ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে হাসিনা সরকার ‘তত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় যার জন্য খোদ আওয়ামীলীগ দীর্ঘদিন রাজপথে ছিল, সংগ্রাম করেছে।
৭২ এর সংবিধান একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে ক্ষমতা দিয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এই পরিমান ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার নজির নাই। সংবিধান অনুযায়ী কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি যে দন্ড মৌকুফ ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিহিনী ও কমিশনের প্রধান দের নিয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই কাজগুলোও স্বাধীন ভাবে করার অধিকার সংবিধান তাকে দেয়নি। তাকে সবকিছুই করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে ৭২ সংবিধান যে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে রাষ্ট্র যদি তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথেও পরিচালিত হয় তবুও সাংবিধানিক ভাবে তা প্রতিহত করার কোনো বিধান নাই। সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র থাকার পরও বিগত হাসিনা সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলো একের পর এক বন্ধ করে দেয়া বা বেসরকারি খাতে দিয়ে দেবার ক্ষেত্রে সরকারকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয়নি। স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের আইনি কাঠামো, বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রায় সব বিধিবিধান বাংলাদেশে সংবিধানে বহাল রাখা হয়। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দমনমূলক আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানকে বাতিল বা সংস্কার করার বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এটা ছিল একটা দুর্বলতা। আইন যদি গণবিরোধী হয়, আইন যদি লুটেরাদের পক্ষে যায় আর সংবিধান যদি সেই সকল আইন এর পৃষ্টপোষকতা করে তবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বঞ্চিতই থেকে যাবে। সম্পদের উত্তরাধিকার প্রশ্নে ব্রিটিশ আমলে অনুসৃত বিভিন্ন ধর্মীয় আইন এখনো বহাল আছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই সংবিধানে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সম্পত্তি উত্তরাধিকার প্রশ্নে বোনেরা ভাইদের তুলনায় বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের আয়-ব্যায় এবং রাষ্ট্রের বন্টন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার ৭২ এর সংবিধান কাউকে দেয়নি। ফলস্বরূপ আমরা দেখি সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ, লুটপাট এবং যত বড় বাজেট, উন্নয়ন প্রকল্প ও স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে বৈষম্য তত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই বাড়ছে সম্পদের পুঞ্জীভবন এবং অনুপার্জিত সম্পদ ভোগের প্রবণতা। রাষ্ট্রে মোট আয়ের যোগান কারা দিচ্ছে এবং কাদের পিছনে এই সম্পদ খরচ করা হবে তার যে আইন কাঠামো, সংবিধান সেই আইন কাঠামোকে প্রশ্নের উর্ধে স্থান দিয়েছে। সংবিধান অনুসারে যে সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে দেখা যায় মোট ভোটের ৪০/৪৫ শতাংশ পেয়েও একটি রাজনৈতিক দল সংসদে তিন ভাগের দুই ভাগ আসন পাচ্ছে আবার ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে আরেকটি দল সংসদে আসন পাচ্ছে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ। বর্তমানে অধিকাংশ উন্নত দেশেই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে যেখান জনগণের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন তুলনামূলক গ্রহনযোগ্য। ৭২ এর সংবিধান বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল জাতিসত্তার স্বীকৃতি দেয়া হয়নি যা রীতিমতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা ও স্বপ্নের যে প্রতিফলন আমরা সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে দেখতে পাই সেখানে উল্লেখ আছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, প্রজাতন্ত্রের উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বন্টন প্রণালীসমূহের মালিক ও নিয়ন্ত্রক হইবে জনগণ।‘ রাষ্টের উপর জনগণের মালিকানা প্রশ্নে যেই সকল অসঙ্গতি ও সাংঘর্ষিক আইন কানুন, বিধি বিধান ও ধারার উল্লেখ আছে সেগুলা একে একে নির্মূল করাই এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।