একবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘হুজুর, আপনার বাড়িতে কেউ গেলেই সঙ্গে সঙ্গে আপনি তাকে কিছু খেতে দেন। কারণ কী?’
মওলানা বললেন, ‘মানুষের খিদা কী জিনিস, তা আমি ছোটকালেই দেইখেছি। কচু, ঘেঁচু, জোয়ার, বাজরা খাইয়া মানুষকে বাঁচতে দেইখেছি। যে কৃষক জমিদার-জোতদারের ফসল ফলায় সেই কৃষকেরে আমি ভাত না খাইয়া মরতে দেইখেছি। দূরদারাজ থিকা মানুষজন আমার কাছে আসে, কোন সময় কী খাইয়া রওনা দিছে।’
বিদেশীরা তাকে বলে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ নাহলে ‘মাও অব ইস্ট ইনডিজগাইজ অব এ প্রিস্ট’। প্রথম বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে বলে এসেছেন, আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম, আমার রাজনীতি শান্তির, আমি শান্তির মাঝেই বাস করি এবং শান্তিই আমার অভিবাদন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা বলছি। বাংলার মাওলানা, লাল মাওলানা। মানুষ তাকে মজলুম জননেতা বলতে কুণ্ঠা বোধ করে না, কিন্তু পেছন দিক থেকে কমিউনিস্ট তাকমা দিয়ে দু’ঘা মেরে দিতেও ছাড়ে না। আমাদের মাওলানা; লাল মাওলানা।
জামাত সম্পর্কে সেই তখনকার দিনেই বলেছিলেন, ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতের ইসলামও ইসলাম নয় । আসলেই এটা কোন ইসলাম নয় বরং এটা হল মওদূদীবাদ । কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রান তারা ইসলামকে ভালবাসে তাই ইসলাম শুনলেই যাচাই বাছাইয়ের মানসিকতা থাকে না।’
পাকিস্তানের মুলতানে প্রখ্যাত সাংবাদিক এরশাদ মজুমদারকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, মাওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে ধনী পরিবার।
মাওলানা সাহেব ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাকুমুসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। এরপর ৭০-এর ২৩ নভেম্বর তিনি পল্টনের জনসভায় স্লোগান দেন, ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। শামসুর রাহমান তখন কবিতা লিখলেন—‘হায়, একি মন্ত্র জপলেন মওলানা ভাসানী’।
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।
মওলানার দাড়ি-টুপি ও লেবাসের কারণে তাঁর প্রতিপক্ষের জন্য প্রচার করা সহজ যে তিনি একজন গ্রাম্য মুসলমান নেতা ছিলেন। সেকালের বাংলার জমিদারদের ৮০ শতাংশ ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী এবং তাঁদের প্রজাদের ৭০ শতাংশ ছিলেন মুসলমান। তিনি যখন জমিদার-জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তা যাদের গিয়ে আঘাত করে, তাদের বারো আনাই হিন্দুধর্মাবলম্বী। সুতরাং বলা সহজ, ভাসানী একজন মুসলমান নেতা ও সাম্প্রদায়িক। যদিও তাঁর অনুসারীদের একটি বিরাট অংশ ছিল হিন্দু। বাংলা ও আসামের বহু হিন্দু তাঁকে অবতার জ্ঞান করত। তিনি বলতেন, হিন্দুর ক্ষুধা, মুসলমানের ক্ষুধা, বৌদ্ধের ক্ষুধা, খ্রিষ্টানের ক্ষুধা একই রকম। শোষক ও জালেমের কোনো ধর্ম নেই। মজলুমের কোনো ধর্ম নেই। জালেম হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কালো চামড়ার হোক আর সাদা চামড়ার হোক—সব সমান।
ভাসানী কোন অবতার ছিলেন না, আর দশটা মানুষের মত তারও সীমাবদ্ধতা ছিলো, এবং তার মত বিশাল নেতার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুলের জন্যে জাতিকে কড়া মাশুল দিতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে জিন্নাহর সাথে সুসম্পর্ক, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার অনুসারীদের দদ্যুল্যমনতা, এবং ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে তার কাজকর্ম নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। যত বিতর্কই থাকুক তিনি যে সত্যিকারে একজন কৃষকের নেতা ছিলেন, দরিদ্রের ভালো চাইতেন সেটা তার শত্রুও মেনে নেবে। তাই আমাদের উচিত এই মহান নেতার কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করা।
কারণ দিনের শেষে কমিউনিস্টদের গালি দিতে হলে আপনাকে ভাসানী জানতে হবে, আবার সত্যিকারে বাংলাদেশকে জানতে হলেও ভাসানীকে জানতে হবে, কোন বিকল্প নাই।
আওয়ামী লীগ পাঠ্যবই থেকে ভাসানী সম্পর্কিত সবকিছু উঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসে কোন জালিম কি কখনো মজলুমের মন থেকে তার নেতার নাম মুছে দিতে পেরেছে?