বিশ্বকাপ শুরু হতে ২৪ ঘণ্টাও নেই। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। এবং তার আগে অনুমিত নাটকই চলছে।
যেমনটা এশিয়া, আফ্রিকায়, লাতিনে কোনো আয়োজনের আগে ইউরোপ, তাদের গণমাধ্যম আর তাদের চাকর-বাকররা নিয়মিতই করে। ২০১০ এ করছে, ২০০২ এ করছে, ২০১৪তে করছে, এই শেষবার রাশিয়া ওয়ার্ল্ডকাপেও করছে। ছুতানাতা খুঁজে বের করে একটা হামবড়া ভাব দেখানো। এই দেখো ছোটলোকের জাত, পারে নাকি কোনো অনুষ্ঠান করতে। এটা নাই, সেটা করতে দেয় না। আরো কত। ক্ষ্যাত। লোকজন বিক্ষোভ করতেছে। কী ছিরি। এরা করে আয়োজন! হতো যদি প্যারিসে, দেখতে কী কী সব করতাম। কী জাঁকজমক। কলস কলস বিয়ার, এটা সেটা।
জাপানে অলিম্পিক। পশ্চিমা মিডিয়ার ফোকাস কী? দেখো, লোকজন অলিম্পিকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। সে তো ইউরোপেও হয়, কিন্তু সেসব খবর তখন বেমালুম গায়েব হয়ে যায়।
এবারের যত অভিযোগ, কাতার টাকা খাওয়াইয়া আয়োজনের অনুমতি পাইছে, কত শ্রমিক মাইরে ফেলছে, সেখানে এলজিবিটি ওপেনলি র্যালি করতে পারবে না, মদ-বিয়ার নাই।
কী মারাত্মক সব অভিযোগ। যেন ইউরোপে খেলা হইলে চাহিবামাত্র আমি গণ্ডায় গণ্ডায় পান পেয়ে যাইতাম। এই যা, লোকজন ছোটলোকের দৌড় টের পেয়ে গেছে। কোথায় মদ-বিয়ার, কোথায় পান! কিংবা, ইংল্যান্ডে ইউরোর সময় আমি স্টেডিয়ামের কাছে রাজতন্ত্রবিরোধী মিছিলের অনুমতি পেয়ে যেতাম, কিংবা ভেতরে (এখন খেলা হলে) ফাক দ্য ইউক্রেইন লেখা ব্যানার ধরে থাকতে পারতাম।
এগুলো যে কালচারাল ডিফারেন্স, তা তো অস্বীকারের উপায় নাই। কিন্তু তাদের কথা শুনলে আপনি একটা আশরাফ-আতরাফ ভেদ টের পেয়ে যাবেন।
সবের মধ্যে তুলনামূলক গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, অভিবাসী শ্রমিকের মারা যাওয়া।
গার্ডিয়ানের ২০২১ সালের একটা হিসাব বলছে, কাতার বিশ্বকাপের কাজ শুরু করার পর ওই বছর পর্যন্ত সাউথ এশিয়ার ৫টা দেশের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক মারা গেছে। মৃত্যুর এই হিসাব আসছে ওই দেশগুলোর দূতাবাসের কাছ থেকে। দূতাবাসগুলো কম্বাইন্ড হিসাব দিছে, কারণ তাদের কাছে আলাদা করে কাতারে স্টেডিয়াম বানানো বা বিশ্বকাপের কাজে মারা যাওয়া শ্রমিকের হিসাব নাই। এদিকে ফিফা প্রেসিডেন্ট আজকে স্পষ্ট করে বলছেন, হতাহত প্রত্যেকে বা তাদের পরিবার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।
এই পুরো ঘটনায় কাতার যদি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে না পারার মতো অন্যায় করে ফেলে, তাহলে আগামীবার যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপ আয়োজন কি করে ঠিক হয়? অন্য সময় বাদ, গত দুই দশকে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় তারা যত বেসামরিক মেরেছে, এখনও মারছে, তাতে কী তারা আগামী কয়েক সহস্র বছরেও কোনো আয়োজনের দাবিদার হতে পারে?
ইউরোপের কোনো দেশ পারে? আফ্রিকায় ফ্রান্স এখনও যা করে বেড়াচ্ছে, পারে তারা? অস্ট্রেলিয়া কত শতসহস্র আদিবাসী মেরেছে, তারা পায় কোনো আন্তর্জাতিক আয়োজন?
কিন্তু না, তাদের সব আলো ঝলমলে অনুষ্ঠান। উদ্বোধন ভালো না লাগলেও, জোর করে ভালো বলতে হবে, না হলে স্ট্যাটাস থাকে?
অনেকের মনে হতে পারে, এরকম হিসাবে টান দিলে তো দুনিয়ার কোনো দেশেই আর বৈশ্বিক আয়োজন হয় না। হয় না তো। কিন্তু হয়।
ফিফার যুক্তি বলছে, ফুটবলের আরও গ্লোবালাইজেশন। সে বিচারে তারা কাতারকে বেছে নিয়েছে। চীন-ভারতের মার্কেট যেন মিস না হয়, তার জন্য বিশ্বকাপে দল পর্যন্ত বাড়ানোর কথা ভাবছে। ভুল তো কিছু করেনি। যে যোগ্যতায় বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে, সেই একই তো যোগ্যতা।
ইউরোপ আমেরিকার কেন জ্বলে, সেটা তো বোঝা যায়। কিন্তু আপনার চান্দি গরম হবে নও-ওয়েস্টার্নারদের কথাবার্তা শুনলে। নও-মুসলিমরা যেরকম নিজেদের ঈমান শক্ত দেখানোর জন্য পারলে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, তেমনি এই নও-ওয়েস্টার্নারদের কাছে পশ্চিমের গু-ও ভালো।
জানা কথাই, ইকোনমিক অপরচুনিটি তুলনামূলক কম, এমন একটা দেশ থেকে অপরচুনিটি বেশি এমন কোনো দেশে গেলে, সেখানকার ডেভেলপমেন্ট চোখে লাগার কথা। সেই ডেভেলপমেন্টের শ্বাস নিয়ে নিজের আশপাশের মানুষকে, নিজের দেশকে কীভাবে ডেভেলপ করা যায়, কোথায় খামতি, সেগুলো ভাবা, করার চেষ্টা, এক জিনিস। আরেক জিনিস হচ্ছে, নিজের অ্যাসাইলাম টেকাতে আরও বেশি করে বিবিসি-সিএনএনের লাইন ধরে ভোকাল হওয়া (নিজ নিজ দেশের ফরেন পলিসি না বদলালে, বা না বদলানোর ইঙ্গিত পেলে বিবিসি-সিএনএনও কখনো সরকারি লাইনের বাইরে হাঁটে না)।
এই তল্পিবাহক চাকর বাকররা বুশ-ব্লেয়ারের আগে ইরাকে ‘সবচেয়ে ভয়াবহ মারণাস্ত্র’ দেখে ফেলেছিল, পেন্টাগনের চেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদবিরোধী যোদ্ধা হয়ে গিয়েছিল, ইসরায়েলের চেয়ে বড় জায়নিস্ট হয়ে গিয়েছিল।
কোনো ফায়দা নেই। এই তরিকায় কোনো কিছুরই আর কোনো কিছু হওয়ার আর সুযোগ নেই। পশ্চিমের সব শ্রেষ্ঠত্বের মেয়াদ-ই শেষ হওয়ার পথে। জ্ঞানের জগতেও।
আর হ্যাঁ, বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে জোব্বা, বোরকার ছড়াছড়ি থাকতে পারে, অঘটন, অব্যবস্থাপনাও দেখা যাবে। তা নিয়েও টুট টুট অনেক হবে। নিরাশ হওয়া যাবে না। অবুঝদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে হবে, মরুভূমিতে ঠা ঠা গরমে (রাতে যতই ঠাণ্ডা হোক, এসিতে খেলা হোক) মাথার চান্দি থেকে শুরু করে পায়ের তালু পর্যন্ত ঢাকা কাপড় না পরে ফ্যাশন করা একটু বেশিই দুঃসাহস হয়ে যেতে পারে। আর বেটারা কোটি কোটি ডলার খরচ করে স্টেডিয়াম-ই তো বানিয়েছে। নাহলে ওই টাকাতো রেথন, লকহিড ছলেবলে নিয়ে নিতো। অস্ত্র বানাতো, আর নিওনাৎসিদের হাতে তুলে দিত। তারা ট্রিগার টিপে শতশত অ-পশ্চিমীর জান কবজ করে ফেলতো।
কিন্তু, কাতারও তো দেখি কম কম্প্রোমাইজ করেনি। নারী রেফারি পুরুষদের খেলা পরিচালনা করবে, তাদের হাফপ্যান্টে বাধাও থাকছে না। এদিকে স্টেডিয়ামের স্পেশাল জোনে বিয়ারও মিলবে। এত কিছু করেও কী পশ্চিমে মুগ্ধদের মন পাবে তারা? মনে তো হয় না।
কে জানে, আমি এতক্ষণে হয়তো সিভিলাইজেশন-হেটার তালিকায়ও উঠে গেছি। তাতে আপত্তি নেই। আমি সেই এশীয়, সেই আফ্রিকান, সেই লাতিন, যার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে ছলে-বলে লুট করে নিয়ে, তাতে ফুটানি মারছে, মারতে পারে পশ্চিমারা। ডাকাতের আবার গর্ব থাকে কীভাবে? থাকলে আমার থাকবে। ইনফান্তিনো তো ঠিকই বলেছে- যে অন্যায় করছে, এখনো যা করছে, তাতে আমাকে মোরালিটি শেখানোর কোনো অধিকার থাকে তাদের?
সুতরাং, খেলা হবে।