গণতন্ত্র মূলত এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা কে নির্দেশ করে যা সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকারের নিশ্চয়তাকে সমর্থন করে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সকল নাগরিকের জন্য মতপ্রকাশের সুযোগ তৈরী করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতায় কে থাকবে সেটা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সকল নাগরিক সমান অধিকার প্রাপ্ত হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আমাদেরকে যে গণতন্ত্রের গল্প শোনায় তা মূলত বুর্জোয়া গণতন্ত্র যা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত ব্যাবসায়িরা। এই ব্যাবসায়িদের একটা বড় অংশ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি নয়তো সিন্ডিকেট করে জনগণের টাকা হাতিয়ে বিপুল সম্পদের মালিকে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাবসায়িদের প্রতিনিধিত্ব করা বড় দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাকে দখল করে লুটপাট অব্যাহত রাখার স্বার্থে বুর্জোয়া গনতন্ত্রকেও অকার্যকর করে ফেলেছে। বর্তমানে নির্বাচন থেকে শুরু করে আইন ও বিচার বিভাগ পর্যন্ত একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। রুশ বিপ্লবের নেতা লেলিন বলেছেন, “পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে গণতন্ত্রের গুরুত্ব সমধিক।” লেলিন আরো বলেন, “গণতন্ত্র অর্থে সাম্য বুঝায়। সঠিকভাবে ব্যাখা করলে সাম্য বলতে বুঝায় শ্রেণী-বিলোপ; সাম্যের এই সঠিক অর্থ যদি আমরা গ্রহণ করি, তবেই সাম্যের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের তাৎপর্য এবং স্লোগান হিসেবে সাম্য কথাটির তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে শুধু বাহ্যিক সাম্যই বুঝায়। উৎপাদনের উপায়গুলির মালিকানা ব্যাপারে সমাজের সমস্ত সদস্যের পক্ষে যখন সাম্য আয়ত্ত্ব হবে , শ্রম ও মজুরির সমতা যখন বাস্তবে আয়ত্ব হবে, ঠিক তখনি বাহ্যিক সাম্যের গন্ডি অতিক্রম করে যথার্থ সাম্যে উপনীত হবার প্রশ্ন মানবসমাজের সম্মুখে অবশ্যম্ভাবী রূপে দেখা দিবে।”
বর্তমানে সাধারণ জনগণ ও শ্রমজীবি মানুষ অভাবে ও দারিদ্রে এতো বেশি নিষ্পেষিত যে গণতন্ত্র ও রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো তাদের কাছে বিলাসিতা। শ্রমজীবি জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ প্রচলিত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্ছিত। আবার, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের মধ্যে সেই সচেতনতার জন্ম দিতে পারছে না জাতে করে সাধারণ মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। এই পরিস্থিতিতে, একদল অসৎ ব্যাবসায়ী, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের যোগসাজশে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। গত দেড় দশকে কুইকরেনটান বিদ্যুৎ কোম্পানি গুলোকে এক লক্ষ কোটি টাকা বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রদান করা হয়েছে। উপরন্তু, সরকার দায়মুক্তি আইন করেছে যাতে কেউ সরকারের এই দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। বড় বড় কোম্পানি গুলো নদী খাল বিল দখল করে নিচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা ও আমলাদের বিলাসী জীবনযাপনের ব্যায় বহন করতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। এর ফলে হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। এরই পরিনাম হিসেবে শ্রমজীবী মানুষকে প্রতিদিনের খাবারের গুণগতমান ও পরিমাণ দুই কমাতে হচ্ছে। দেশের এই পরিস্থিতিতেই সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচনের কোনো নজির আমরা দেখতে পাই না। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠ হতে হলে যে ধরনের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন বাংলাদেশে তার কোন অস্তিত্ব নাই। দেশের জনপ্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে চলছে দলীয়করণ| এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক ধরনের সংস্কারের আগে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে কোন ভাবেই অবাধ সুষ্ঠ ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। অপরদিকে ক্ষমতাশীল দল জানে সুষ্ঠ নির্বাচন করলে তাদেরকে ক্ষমতা হারাতে হবে এবং দুর্নীতির দায়ে অধিকাংশ নেতা কর্মীকে কৃতকর্মের ফল স্বরূপ জেলের ভাত খেতে হবে।
এই ভূখণ্ডে যারা প্রগতিশীল রাজনীতির পতাকাটা বয়ে চলছেন, যারা শ্রেণীর রাজনীতিকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাদের সামনে আবার একটি সুযোগ হাজির হয়েছে। বর্তমান পরিস্থির দাবি হচ্ছে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্যাপকতর গণতন্ত্র আয়ত্ব করার জন্য সচেতন ও সুশৃক্ষল ভাবে আত্মনিয়োগ করা। এই তো সুযোগ, জনগণের সামনে বুর্জোয়া রাজনীতির দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে রাজনীতিবিদদের উলঙ্গ করে দেয়ার। বড় দুই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না, তারা বিশ্বাস করে তাদের বিদেশী প্রভুরা তাদের ক্ষমতায় রাখবে নয়তো নিয়ে আসবে। তাই সাধারণ মানুষ যে রোগে শোকে বিপর্যস্ত তাদের দেখার কেউ নাই। কোটি কোটি টাকা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মশা মারতে খরচ করেছে অথচ প্রতিদিন গড়ে দশ থেকে বিশ জন মানুষ ডেঙ্গুতে প্রাণ হারাচ্ছে। এই পরিস্থিতি জনগণের জন্য অপমানের। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সকল অপকর্ম জায়েজ করতে চাচ্ছে। অথচ জনগণকে বুঝাতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে একটি সামাজিক বিপ্লবের চেতনা, যে বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল ও চিনিকল গুলো নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দিতে চাচ্ছে। যার পরিণতিতে শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে, কৃষকরা পাটের মূল্য পাচ্ছে না, সাধারণ মানুষ কে চিনি ক্রয় করতে হচ্ছে তিন গুন দাম দিয়ে।
একটি সুশৃঙ্খল সুসংগঠিত ছোট পার্টির পক্ষেও সম্ভব জনগণকে সচেতন করে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দানে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ যত সংকীর্ণ হয়ে আসবে শ্রমজীবি জনগণের মুক্তির জন্য প্রচার প্রচারণা চালাবার পথও তত সংকীর্ণ হয়ে আসবে, জনগনাকে সংগঠিত করার রাস্তা গুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসবে। কেবল সংগ্রামই পারে শোষিত শ্রেণীকে শিক্ষিত করতে, সংগ্রামই শোষিত শ্রেণীর সামনে তার নিজস্ব ক্ষমতার বিশালত্ব কে উন্মুক্ত করে দেয়, বিস্তৃত করে দেয় তার দিগন্তকে, বাড়িয়ে দেয় শক্তি, মনকে প্রাঞ্জল করে, উদীপ্ত করে তার ইচ্ছাশক্তিকে। সুষ্ট নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে সুযোগ করে দিবে ব্যাপক জনগণের মাঝে যাওয়ার, তাদেরকে আন্দোলনের যৌক্তিকতা বুজিয়ে বলার ও তাদের সংগঠিত করার। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সামনের দিনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। জন আকাঙ্খা শূন্য থেকে শুরু হয় না। তার জন্য প্রয়োজন হয় দৃশ্যমান রাজনৈতিক শক্তি।
অনেককেই উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে শুনি – এই সরকারের পতন ঘটলে কারা ক্ষমতায় আসবে? এই সরকারের আমলে গুম খুন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে নাই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জনগণের টাকা লুটপাট আর পাচারের উৎসব চলছে। সর্বত্র সৃষ্টি করা হয়েছে আতঙ্ক, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই হামলা, মামলা গুম খুনের ভয়। এরকম হতাশা ও অসহায় পরিস্থিতি মানুষ কে ধর্মীয় ভাবাদর্শের অধীন করে ফেলে। তখন মানুষ ইহলৌকিকতার চাইতে অজ্ঞাত পারলৌকিকতার মধ্যে আস্থাহীনতার বিপরীতে আস্থার সন্ধান করে। অন্ধ আস্থা তখন তার চেতনাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। মানুষের এই মানষিক পরিস্থিতির সুযোগ নেয় ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ তখন আস্থা ও নিশ্চয়তার মোহো সৃষ্টি করে ব্যক্তি ও সমাজকে অনুকূলে আনতে সক্ষম হয়। এই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল উত্তর আফ্রিকায় গত শতাব্দীর সত্তর এর দশক থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত। কর্তৃত্ববাদী ইসলামপন্থীরা এমন ব্যবস্থা প্রচলন করেছিল যেখানে গণতন্ত্র পরাভূত হয়েছিল, মানুষের অধিকার অপহৃত হয়েছিল। ইরানেও একই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিলো। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে গণতান্ত্রিক চর্চা সংকীর্ণ করার কোনো বিকল্প তার সামনে নাই। আর এই গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত ধর্মীয় মৌলবাদীদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। সুতরাং, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে না আনলে ভবিষ্যতে কারা ক্ষমতায় আসতে পারে সেই বিষয়টাও বিবেচনায় রাখা জরুরি। জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে ভোট ও ভাতের জন্য লড়াই গড়ে তোলাই আপাদত এই পরিস্থিতিতে অন্যতম সমাধান হতে পারে। অর্থাৎ, জনগণের শক্তির উপর ভরসা করা। অনেকে ভাবতে পারে, যেহেতু বামপন্থীদের এই মুহূর্তে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নাই তাই এই সরকারের পতন হলে হয়তো এর চাইতেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। ৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অর্জনকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের এখনো আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অর্জন গুলা এক দিনে নিঃশেষ হয়ে যায় নাই। ধীরে ধীরে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো সেটা নিঃশেষ করেছে। মূলবিজয় অর্জনের পূর্বে অর্থাৎ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পূর্বে এভাবেই হয়তো লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ৯০ এ স্বৈরাচার সরকারের যদি পতন না ঘটতো নিশ্চিত ভাবে পরবর্তী কালে গণতন্ত্র ও মানুষের জীবন আরো সংকটের মধ্যে পড়তো। যেটা বর্তমান সময়ের জন্য ও প্রযোজ্য। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন সাহস ভয়ের অনুপস্থিতি নয়, বরং ভয়কে জয় করা।