গত ৭ই নভেম্বর আমরা পালন করলাম ১০৭তম রুশ বিপ্লব বার্ষিকী। নিঃসন্দেহে রুশ বিপ্লব ছিল গত শতাব্দীতে সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রুশবিপ্লব এবং পরবর্তী সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা প্রমান করে দিয়েছে যে পুঁজিবাদের বিকল্প সম্ভব। আজকের পুঁজিবাদী দেশসমূহে মানুষে মানুষে লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদে যে বিভাজন আমরা দেখি সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থায় তা ছিল অনুপস্থিত। সোভিয়েত দেশ দেখিয়ে দিয়েছিলো যে পরিকল্পিত অর্থনীতি বাস্তবায়ন করে বেকারত্বের অভিশাপ দূর করা সম্ভব। শাসক শ্রেণীকে পরাস্ত করে সকল প্রকার শোষণের অবসান নিশ্চিতের লক্ষ্যে যে বিপ্লব তা মোটেও সহজ বিষয় ছিল না। এই দুঃসাধ্য অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেনিন। রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিন কে স্মরণ করে তার উত্তরসূরি স্তালিন বলেছিলো, ‘লেনিন সত্যি সত্যি বিপ্লবী-বিস্ফোরণের এক অদ্ভুত প্রতিভা ছিলেন। তিনি আগে থেকেই বুজতে পারতেন, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী কোন দিকে পা বাড়াবে, আর কোন রাস্তায় পা বাড়ালে বিপ্লব সফল হবে। যেন সমস্ত ঘটনাকে নিজের হাতের তালুতে রেখে পরখ করছেন। বিপ্লবের সময় শুধু একটি ঘন্টা নয়, প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য আছে, আর লেনিন প্রতিটি মুহূর্তকে যথোপযুক্ত কাজে লাগিয়েছিলেন।’
১৯১৭ সালের অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে ফেব্রুয়ারী মাসে (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী মার্চ মাস) সংগঠিত বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার শেষ জার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশেও স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ১৯১৭ সালের বুর্জোয়া বিপ্লবের পর লেনিন রাশিয়াতে ফিরে আসেন এবং তার বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেন, যে থিসিসের মূল পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েতগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। এপ্রিল মাসে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার পার্থক্য লেনিন তুলে ধরার প্রয়াস চালান। অন্তর্বর্তী সাময়িক সরকার কে সমর্থন করা উচিত কিনা এই প্রসঙ্গে ডানপন্থী কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নিঃশর্ত সমর্থন জানায় কারণ তারা মনে করতো এই সরকার পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করবে। সোশ্যাল ডেমোক্রাট এবং সোসালিষ্ট রেভোলুশনারিরা শর্তসাপেক্ষে সাময়িক সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। অপরদিকে বলশেভিকরা ঘোষণা দেয় যে পুঁজিপতিরা এই সরকারকে সমর্থন জানাতেই পারে কিন্তু আমাদের কাজ হলো সোভিয়েতগুলোর মাধ্যমে পূর্ণ এবং অবিভাজ্য ক্ষমতা দখলের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা। প্রচলিত আমলাতন্ত্র কি থাকবে এই প্রশ্নে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো আমলাতন্ত্রের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যাক্ত করে। অপরদিকে বলশেভিকরা স্পষ্ট ঘোষণা দেয় যে এটা রাখা যাবে না, সকল কর্মকর্তা এবং সব ধরণের প্রতিনিধিগণ কেবল নির্বাচিত হবেন না, যে কোনো সময় তারা অপসারণযোগ্য হবেন। একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতনের বেশি তারা কেউ পাবেন না। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপরেখা প্রস্তুতিতে মনোযোগী। বুর্জোয়া সরকার যাতে জারের মতো স্বৈরাচারী না হতে পারে সেই লক্ষ্যে শ্রমিকরা বিরাট বিরাট বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করছিলো। মে দিবসের অভূতপূর্ব মিছিলের পর ১৮ জুনে বলশেভিক পার্টির ঝাণ্ডার নিচে পাঁচ লক্ষ শ্রমিক এবং কৃষক অংশগ্রহণ করে। স্তালিন সেখানে ঘোষণা দেন যাতে উৎপীড়ণ এবং অত্যাচার আবার নতুন করে শুরু হতে না পারে সেই জন্য সকল খেটে খাওয়া মানুষ কে প্রস্তুত থাকতে হবে। সমাবেশ থেকে আরো ঘোষণা দেয়া হয় ‘ স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের যারা দুশমন, তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য আমাদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দাও।’ অন্তর্বর্তী সরকার আতঙ্কিত হয়ে পরে। ৩ ও ৪ জুলাই তারা শ্রমিক সমাবেশে গুলি চালায়, ‘প্রাভদা’-র কার্যালয় তছনছ করে এবং লেনিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষ চাপিয়ে তাকে গ্রেফতার করার জন্য ওয়ারেন্ট জারি করে। লেনিন আবার বাধ্য হন আত্মগোপনে যেতে। এভাবেই আগাচ্ছিলো অক্টোবর বিপ্লবের প্রস্তুতি।
জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোনো দিকে আগাচ্ছে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির কারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট এখনো লাঘব হয়নি। আইনশৃখলা এখনো স্বাভাবিক করা যায়নি। শ্রমিকদের মিছিলে গুলি অব্যাহত আছে। ১৯১৯ সালের কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে লেনিন বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘সোশ্যালিস্টরা যে প্রধান জিনিসটা বুজতে পারে না এবং যা তত্ত্বের ক্ষেত্রে তাদের অদূরদর্শিতা, বুর্জোয়া কুসংস্কারের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং সর্বহারাদের প্রতি তাদের রাজনৈতিক বিস্বাসঘাতকতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা হলো এই যে, পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যকার অন্তর্নিহিত শ্রেণিসংগ্রাম যখন গুরুতরভাবে তীব্র আকার ধারণ করে তখন বুর্জোয়া একনায়কত্ব অথবা সর্বহারার একনায়কত্ব ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। তৃতীয় কোনো পথের স্বপ্ন দেখা পেটিবুর্জোয়াসুলভ বিলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ চারপাশের প্রতিটি ঘটনা প্রবাহ আমাদের সেই কথাই বার বার মনে করিয়ে দেয়। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ধীরতা যে বার্তা আমাদের দিচ্ছে তা হলো এই সরকার চেষ্টা করবে তাদের শাসনের মেয়াদকে যতটা সম্ভব দীর্ঘায়িত করা। অজুহাত হিসেবে তারা সামনে দাঁড় করাচ্ছে সংস্কার কর্মকান্ড যাতে করে ফ্যাসিবাদের পুনরাগমন না ঘটে।
আমরা ইতিহাস থেকে দেখেছি পুঁজিবাদের সঙ্কটের কালেই ফ্যাসিজমের উদ্ভব হয়েছিল। সেই ফ্যাসিজম সমাজে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক চর্চাগুলোকে প্রতিনিয়ত সঙ্কুচিত করে ফেলছিল। বিগত আওয়ামী সরকার যে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। তার পূর্বে বিএনপি সরকারের মধ্যেও আমরা দেখেছিলাম পছন্দের ব্যাক্তিকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে ক্ষমতায় ফেরা নিশ্চিত করার একটা প্রবণতা। বুর্জোয়া দলগুলো ক্ষমতার মোহে কোনো আইন কানন ও জনগণের জানমালের পরোয়া করে না। বিগত ৩০ বছরে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে এক দল একবার নির্বাচিত হলে পরবর্তী নির্বাচনে আর জনগণের সমর্থন পায় না। এর কারণ হতে পারে যে বিগত সময়ে যারা একবার ক্ষমতায় গিয়েছে তারা সবাই কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছে কিন্তু জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নি। বিপুল রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণনের লোভ তাদের এমন অন্ধ করে তুলে যা গণতান্ত্রিক চর্চাকে সংকুচিত করে ফ্যাসিস্ট হতে তাদের প্ররোচিত করে। তাহলে এই ফ্যাসিজম কে প্রতিহত করতে হলে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও আমলারা যে অপ্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, যে বিলাসী জীবন যাপন করে সেটা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে পরে আছে সেখানে মন্ত্রী আমলাদের বিলাসী জীবন অনেক ক্ষেত্রে অশ্লীলও বটে। তাই আমাদেরও বলশেভিক পার্টির মতো আওয়াজ তোলা উচিত যাতে জনপ্রতিনিধিরা একজন দক্ষ শ্রমিকের চাইতে বেশি বেতন ভাতা না পায় এবং সেটা বর্তমান উপদেষ্টাদের থেকেই শুরু করা উচিত। গণতন্ত্রকে সংহত করতে চাইলে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে কৃষক শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব জরুরি কারণ তারাই দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপ (২০২২) এর রিপোর্ট অনুযায়ী সমাজের সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ মাত্র। আর একদম ওপরতলার ১০ শতাংশের আয় দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। একজন গরিবের তুলনায় একজন ধনীর আয় অন্তত ১১৯ গুণ বেশি। একজন গরিব ১ টাকা আয় করলে একজন ধনী আয় করেন ১১৯ টাকা। আয় বৈষম্যের সংস্কার ব্যতীত অন্য অনেক সংস্কারই অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। মানুষের জীবনদৃষ্টি গড়ে তোলে তার চারপাশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক। অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের উপর প্রভাববিস্তারকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বাস্তবসম্মত কোনো রোডম্যাপ আমাদের দিতে পারে নাই। সকল মানুষের জন্য একটি সুন্দর ভবিষৎতের লক্ষ্যে উন্নততর কোনো দিকনির্দেশনা তাদের কাছ থেকে পেয়েছি এই দাবি আপাদত আমরা করতে পারছি না। সঙ্কটের উৎস সঠিকরূপে চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করতে পারে নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন মত কে দমন করার ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা বিগত স্বৈরাচার সরকারের মতোই। যার ফলে সম্প্রতি দেশবাসীর মধ্যে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে আশংকা দেখা যাচ্ছে। বিগত স্বৈরাচার সরকার যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেই দিক থেকে কোনো ভিন্নতা নেই। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানে বহু শ্রমজীবী মানুষ জীবন দিয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনে গুলি করে শ্রমিক হত্যা এখনো থামেনি। প্রকৃত গণতন্ত্র সংহত করতে চাইলে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে। ভ্যাট ট্যাক্স এর মাধ্যমে জাতীয় আয়ের মূল যোগানদাতা কৃষক শ্রমিক, কর্মজীবী জনগণ অথচ জাতীয় বাজেটের খুব কম অংশই তাদের চিকীর্ষা, তাদের সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য বরাদ্দ হয়। বিদ্যমান বৈষম্য নির্মূলের উদ্যোগ না নিলে গণতন্ত্র কে স্থায়ী রূপ দেয়া সম্ভব হবে না। আর গণতন্ত্র কার্যকরী না করতে পারলে ফ্যাসিবাদ আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়।কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকান্ড স্থগিত করার লক্ষ্যে আদালতে রিড করার কথা আমরা শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আওয়াজ উঠছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যে গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক, জামায়েত ইসলামও যে একাত্তরের গণহত্যার সাথে জড়িত এই বিষয় নিয়ে কোনো আওয়াজ আমাদের কানে আসছে না। আমাদের চারপাশের ঘটনাবলী আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে শ্রমিক কৃষকের রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া এবং তাদের শক্তিশালী রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলা ব্যতীত বাংলাদেশের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কাটবে না। আর সেই লক্ষ্যেই আমাদের বার বার ফিরে যেতে হয় রুশ বিপ্লবের কাছে। রুশ বিপ্লব আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিপ্লবের জন্য যেমন একটা বিপ্লবী পার্টি প্রয়োজন বাস্তবতার নিরিখে তেমনি বিপ্লবী তত্ত্বায়নও জরুরি। তাই আসুন রুশ বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বলশেভিক পার্টির মতো একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলি এবং এই অঞ্চলের শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে শেষ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাই।