যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। তার কিছুদিন পরে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সেলফি নিয়েও রাজনীতির ময়দান সরগরম। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে যেই খবরটি খুব বেশি পৌঁছায়নি সেটা হচ্ছে জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট) নামের যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন রকম চুক্তি করব বলে আমার মনে হয় না।‘ ধারণা করা হচ্ছে চুক্তির প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ হওয়ায় বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালের শুরুতে জিসোমিয়া চুক্তির খসড়া বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে। বিভিন্ন সরংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে চুক্তির বিভিন্ন বিষয় আলোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে ফিরতি সফরে আসবে। বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো মহল ধারণা করছে, শেখ হাসিনা সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তির জন্য চাপ দিতেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।
জিসোমিয়া হচ্ছে মার্কিন সরকার ও মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সইকারী দেশের সরকার ও সমরাস্ত্রবিষয়ক বিশেষায়িত সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত গোপন তথ্য বিনিময়ের চুক্তি । বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশের সঙ্গে জিসোমিয়া সই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এবার বাংলাদেশে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এসব ক্রয় প্রস্তাবের তথ্যের প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দিক খুবই স্পর্শকাতর। বাংলাদেশ যে সমরাস্ত্র ক্রয় করে তার মূল ক্রেতা চীন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র লবি খুবই শক্তিশালী। এই লবিটি বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য তার দেশের সরকার কে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নে অনেক আধুনিক সামরিক সরঞ্জামের প্রয়োজন হবে। এই লক্ষকে সামনে রেখে এগুচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জামের দাম তুলনামূলক বেশি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি এবং সমুদ্রসীমার আকার বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে পারবে বলে আশাবাদী।
জিসোমিয়া চুক্তি সই করার জন্যে যে পাঁচ ধাপের প্রক্রিয়া রয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশ তৃতীয় ধাপের কাজ করছে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে আইনকানুনে সামঞ্জস্য সৃষ্টির কাজ। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আইনের ইংরেজি পরিভাষা সৃষ্টি করা। এর পরেই রয়েছে সার্বিক মূল্যায়নসহ আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং এবং সরকারের অনুমোদনের প্রক্রিয়া। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন। ঢাকায় সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নবম নিরাপত্তা সংলাপে প্রস্তাবিত জিসোমিয়া চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এরই মধ্যে সামরিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ এই চুক্তির পক্ষে ওকালতি করে গণমাধমকে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জিসোমিয়া চুক্তি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশও যদি এই চুক্তি করে তবে তা ইতিবাচক। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নেই। জিসোমিয়া চুক্তি হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটা শুধু সামরিক নয়; বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্যও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।‘ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক সামরিক সরঞ্জামের প্রয়োজন কে এই চুক্তির পক্ষে ঢাল হিসেবে দাঁড় করাতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের উপকূলীয় সীমান্তের নিরাপত্তা, নিরাপদ সাইবার স্পেস, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাস দমন, সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন সহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করছে। যদিও জিসোমিয়া চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ প্রযুক্তিগত গোপনীয়তার দিকে। আকসা (অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট) নামের আরও একটি চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেই চুক্তির অধীনে মার্কিন বাহিনী বিভিন্ন দেশের সাথে খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি বিনিময় করে থাকে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে আকসা ও জিসোমিয়া সামরিক চুক্তি নয় কারিগরি চুক্তি। দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করে নির্বাচনের পূর্বে জনগণের মৌলিক চাহিদাকে অপূর্ণ রেখে সমরাস্ত্র কোম্পানিগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ধরণের সামরিক চুক্তির গোপন তৎপরতা দেশের মানুষের সাথে বিস্বাসঘাতকতা। সরকারের উচিত হবে, এই দেশের কৃষক শ্রমিকের টাকায় করা যেকোনো ধরণের ক্রয়ের লক্ষে সম্পাদিত চুক্তি জনগণের কাছে উন্মুক্ত করা। আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিচালিত হয় বড় বড় কোম্পানিগুলোর স্বার্থে। দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যারা চালায় তারা নির্বাচিত হয় না, যারা নির্বাচিত হয় তারা চালায় না। তাই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে বিভিন্ন দেশে তাদের হস্তক্ষেপের যে নজির আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখি সেগুলো মূলত পরিচালিত হয় কর্পোরেট কোম্পানি গুলার স্বার্থে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সকল বিষয়ে সচেতনতা তৈরী করে নিজেদের স্বার্থ ও সম্পদ রক্ষার্থে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানানোর কোনো বিকল্প নাই।