পুঁজিবাদী সভ্যতার এক নির্মম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের গণহত্যা, ফিলিস্তিনকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পশ্চিমা চক্রান্ত। অথচ ফিলিস্তিনের পার্শবর্তী আরব দেশসমূহ কিভাবে বিনা প্রতিবাদে এই বরবর হত্যাযজ্ঞকে মেনে নিচ্ছে? অধিকাংশ আরব দেশেই রাজতন্ত্র নয়তো স্বৈরশাসক ক্ষমতায়, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক যে চর্চা তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচের অধিকাংশ মানুষ ইসরাইলের এই বরবর হত্যাকাণ্ডের বিরোধী। কিন্তু বর্তমানে মধপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের সরকার মার্কিন অনুগত। কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারার এটাই অন্যতম কারণ। ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় শহর বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে অথচ যে সকল দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা অনুপস্থিত সেই সকল দেশে ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে বিক্ষোভ আমাদের চোখে পড়ছে না। যদিও ইসরাইলে কমিউনিস্ট পার্টি সহ বিবেকবান মানুষ গাজায় হামলার ধারাবাহিক প্রতিবাদ করে আসছে। আমাদের পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচয় দিলেও আমরা জানি, সেখানে একটি প্রতিক্রিয়াশীল উগ্রমৌলবাদী সরকার দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতায়। মৌলবাদী বিজেপি সরকারের মধ্যে আরএসএস এর প্রভাব খুব বেশি। সেই আরএসএস জায়নবাদী শাসনের পক্ষে। বিজেপি সরকার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ভোট না দিয়ে যে কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইতিহাসে তেমনটা দেখা যায় নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ইসরাইলে হামলার প্রতিবাদে যে দায়সারা গোছের প্রতিবাদ জানিয়েছে সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই হামলার অন্যতম সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি আমাদের উদ্বেগের অন্যতম কারণ। যদিও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য কোনো সুফল এই দেশের মেহনতি মানুষ এখনো পায়নি কিন্তু নির্বাচিত একটি সরকারকে জনগণের আখাঙ্খাকে বিবেচনায় নিতে হয়। ২৪ এর অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বর্তমান সরকার গঠিত হলেও উপদেষ্টাদের অধিকাংশের এই অভ্যুত্থানের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
২৪ এর অভ্যুত্থান পরবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে জনগণ অকাতরে জীবন দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে পারে কিন্তু পরবর্তীতে সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে না পারলে যেই লক্ষ্যে জীবন দিয়ে জনগণ সরকার পতন ঘটালো, রাষ্ট্র ও সমাজ সেই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এই শিক্ষা নতুন নয়, পূর্ববর্তী প্রতিটি অভ্যুত্থান কিংবা বড় আন্দোলনে সাধারণ জনগণকে এই উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অপরিহার্য কার্যকরী দেশব্যাপী সংগঠন , জনসম্পৃক্ততা এবং কার্যকরী পরিকল্পনা। অনেকেই মন্তব্য করছেন, স্বাধীনতা অর্জনের বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এতটা প্রভাব বিস্তার আগে কখনো করতে পারেনি। আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি উভয়ই অতীতে নিজ নিজ স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে এবং তাদের পুষ্টি জুগিয়েছে। জামায়াতের অনুসারীরা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদেরই একটা অংশ বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করছে যে ইউনুস সরকারকে আরো ৫ বছর ক্ষমতায় রাখা জরুরি। কারণ তারা জানে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে, সরকারি পর্যায়ে তাদের এই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাদেরই লোকজন ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্ন ভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। ৭১ এর বিজয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে তারা ছুড়ে ফেলে দিতে চায়। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর চাইতে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দেশব্যাপী অনেক বিস্তৃত কিন্তু জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবার কূটকৌশলের দিকদিয়ে জামায়াত অধিকতর সিদ্ধহস্ত, তাদের কর্মীবাহিনী অনেকবেশি পার্টিজান। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার পরিবর্তন হলেও জনগণের ভাগ্যের মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ কিন্তু জামায়েত সহ বিভিন্ন ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত করার জন্য দেশে একটি নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়ছে। বিগত গ্রহণযোগ্য কোন জাতীয় নির্বাচনে জনগণ উগ্রপন্থার পক্ষে রায় দেয় নি। এবং নির্বাচনের পূর্বে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে, যতটা সম্ভব নির্বাচনের মাঠ সকল প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। টাকার খেলা বন্ধ করার জন্য জনমত গড়ে তুলে সরকারকে তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
বর্তমান সরকার ‘সংস্কার’ নামক একটি মুলা জনগণের মাথার উপর ঝুলিয়ে রেখেছে, ঠিক যেমন স্বৈরাচার সরকার জনগণকে উন্নয়নের গাল-গল্প শুনিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সবচাইতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে রাজনীতি সচেতন ও শ্রেণী সচেতন জনগণ। তাই প্রকৃত অর্থেই যদি গণতন্ত্রকে স্থায়ীরূপ দিতে হয় তাহলে এই দেশের মেহনতি শোষিত জনগণের জীবনের মান উন্নয়ন করে তার মধ্যে সেই বোধ জাগ্রত করার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে সে তার নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে সঠিক রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু গ্রাম শহরের শ্রমজীবী জনগণ বেঁচে থাকার জন্য এতো কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ যে দেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করার মানসিক স্তরে তারা নাই। মান সম্পন্ন শিক্ষা, চিকীর্ষা সুবিধা তাদের নাই, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নাই। তাই এই মুহূর্তে টেকসই গনতন্তের জন্য প্রধান সংস্কার হওয়া দরকার সকল নাগরিকের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা, চিকীর্ষা সহ মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা যাতে পরবর্তী সরকারগুলো কার্যকর করতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থা করা। সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। গত বছর বিবিসির এক জরিপে উঠে এসেছে ইউরোপ যেতে গিয়ে ভুমধ্যসাগরে ডুবে মারা যাওয়াদের ১২ ভাগই বাংলাদেশী। দেশে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলে এই মানুষগুলোকে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিতে হতো না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জাতীয় সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে। বিগত সরকারের আমলে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যায় করতে হবে। অতীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ ও মেহনতি জনগণের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত অসংখ্য। ধনী ব্যাবসায়ী, ধর্ম ব্যাবসায়ী বা আমলাদের রাজপথে জীবন দিতে আমরা দেখেছি বলে মনে পরে না। অথচ আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তারাই হয় সবচাইতে সুবিধাভোগী। মেহনতি জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেন করে গড়ে তোলার মাধ্যমেই গণতন্ত্র কে স্থায়ী রূপ দেয়া সম্ভব। রাজনীতি ও শ্রেণী সচেতন জনগণই হবে গণতন্ত্র কে সুরক্ষা প্রদানকারী প্রধান শক্তি। ঠিক যেমনটা সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সরকার ছাত্রদের দিয়ে ইতোমধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। এই দলের দেশব্যাপী সাংগঠনিক বিস্তৃতি না দাঁড় করানো পর্যন্ত নয়া ষড়যন্ত্রকারীরা নির্বাচনের সঠিক দিন ক্ষণ ঘোষণা করতে আগ্রহী নয়। তারা হয়তো চিন্তা করছে নির্বাচনের সময় যত পিছাবে তরুণ ভোটারের সংখ্যা তত বাড়বে, তাদের ভোট বাড়বে। কিন্তু আশংকার বিষয় হচ্ছে বর্তমান সরকার আইনশৃংখলা স্বাভাবিক করতে পারছে না, এই সুযোগে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা তাদের তৎপরতা বহুগুনে বাড়িয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উপর বাধা সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন জায়গায় মাজারে হামলা করছে। এই সব কর্মকান্ড মূলত ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরী করে মানুষকে বিভক্ত করা, তাকে তার রুটি রুজির সংগ্রাম থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বর্তমানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে যেকোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ হাত ছাড়া করবে না। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরী করে ফায়দা নেয়ার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সম্পর্কেও আমরা জানি। তাই বর্তমান সময়ের আশংকাগুলো সম্পর্কে জনগণকে ওয়াকিবহাল করে তাকে সাথে নিয়ে সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সংগ্রাম বেগবান করা এখন অতিশয় জরুরী কাজ।
বিগত ৫৪ বছরে, বিভিন্ন সময়ে বুর্জোয়াদের বিভিন্ন অংশের কর্মকান্ড ও চরিত্র যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে যে বিষয়টি আমরাদের সামনে প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে, এখানকার বুর্জোয়ারা বা বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল গুলো জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে অপারগ। এমনকি তাদের কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় সম্পদ ও জনগণের জানমালও নিরাপদ নয়। কেবল কমিউনিস্ট ও শ্রেণীসচেতন বামপন্থীরাই জনগনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনে নেতৃত্ব দিতে পারে। কিন্তু বর্তমানে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা কি সেই পরিমান শক্তি সামর্থ রাখে যাতে করে সে জনগণকে নেতৃত্ব দিতে পারে? তাদের নেতৃত্ব ব্যতিত কি দেশে একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব? তাই বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষ করে, অতীতের ভুল গুলো সুনির্দিষ্ট করে এবং সেগুলোর মীমাংসা করে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা জানি, বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠে না। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিভক্তির রাজনীতি, প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম ও জনতার মুক্তি আন্দোলনকে বিভক্ত ও ধ্বংস করছে; দ্বিতীয়ত, শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন ও সংগ্রাম বিপর্যস্ত করছে এবং জনগণকে মোহাবিষ্ট ও বিভ্রান্ত করছে, আর তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘায়িত করছে। এই বাস্তবতা বিভিন্ন তথ্য প্রমান সহ জনগণের সামনে উপস্থাপন করে, জনগণের স্বার্থবিরোধী সকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তাকে সংগঠিত করতে হবে। আর এই সকল কাজেই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারের নাম মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। ১৯৩৯ সালে পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে স্তালিন বলেন: ‘যদি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষায় আমাদের কর্মীদের মধ্যে শিথিলতা দেখা দেয়, যদি এসব কর্মীর রাজনৈতিক এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের মানদণ্ডকে উঁচুতে তুলতে না পারি, তাহলে তারা আমাদের আরাধ্য কার্যক্রমকে মন দিয়ে সমাপ্ত করবে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সংকীর্ণ হয়ে পড়বে যার ফলে তারা যান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে অন্ধের মতো কাজ করবে এবং আমাদের দেশ ও পার্টির কাজ বিপদের মুখে পড়ে যাবে।’