আমরা সবাই ছোট কালে পড়েছি,স্বাস্থ ই সকল সুখের মূল।তখনকার দিনে আমরা বা আমাদের বাবা মা,অথবা আমাদের শিক্ষকরা স্বাস্থ্য বলতে শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য কেই বুঝতেন। মেয়ে হিসেবে শারিরীক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য আমার বাবা মা আমাকে পুষ্টিকর খাবার দিয়েছেন।স্কুলে পিটি বলে একটা ক্লাস হতো,সেখানে শরীর চর্চা শেখানো হতো,আমি বিশেষ আগ্রহ পেতাম না।ছোট কাল থেকেই আমি অল্প পরিশ্রমে ই হাপিয়ে ওঠতাম। দড়ি খেলা, দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি কখনোই প্রতিভার সাক্ষর রাখতে পারিনি। আমি হাইড সিক খেলায় সবসময় চোর থাকতাম,নিজে কদাচিত যদি বা কখনো লুকাতাম আমাকে খুব সহজেই খুঁজে বের করে ফেলতো।
যাহোক মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন একটা কেউ সচেতন ছিলেন বলে মনে পড়ে না। হ্যাঁ মন খারাপ, মন ভালো, দুঃখ , কষ্ট, সেসব নিয়ে সবার একটা নিজস্ব ভাবনা ছিল,সবারই থাকে। তবে কেন হয় মন খারাপ,কেন হয় মন ভালো সেটা কি আমরা জানি?
আচ্ছা আমাদের শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য কি দরকার?সবচেয়ে প্রথম খাবার।আমরা নানারকম খাবার খাই।খাবার খাওয়ার পর প্রয়োজনীয় খাদ্য কনা শরীর শোষন করে নেয়,আর যতটুকু অপ্রয়োজনীয় সেটা মলমূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।এমন কি আমরা যখন শ্বাস নেই তখন বাতাসে থাকা অক্সিজেন টুকুই ফিল্টার করে ফুসফুস নেয়,আর শরীরে মেটাবলিজমের ফলে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় ফুসফুসের সাহায্যে তাও বের হয়ে যায়।ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের সাইকি জন্মের পর থেকেই সচল হয়ে যায়।সে তার চারপাশে থাকা অগনিত তথ্য ভান্ডার থেকে বিভিন্ন তথ্য রিসিভ করে মতিষ্কের কোষে জমা করে।আমরা শূন্য বয়স থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত যা কিছু দেখি সব কিছু আমাদের মতিষ্কের স্মৃতি কোষে জমা থাকে।তবে আমরা স্মৃতি কোষে সেই স্মৃতি গুলো কেই প্রাধান্য দেই যেটা কে আমরা দিতে চাই,যেটা আমার সাইকি কে আরাম দেয়।
এজন্যই আমরা একেকজন একেক রকম।একেক জনের ভালো লাগা মন্দ লাগা একেকরকম।আসলে এরকমটা আমরা করি জীবনের সাথে কোপ করার জন্য। একটা উদাহরণ দেই পরিষ্কার হবে। আমার বাবার সাথে আমার মানসিক একটা ভালো বন্ধন ছিল। আম্মা রাগী প্রকৃতির ছিলেন।সেকারণে ওনার কাছে তেমন ঘেসতাম না।আব্বা খুব অমায়িক প্রকৃতির ছিলেন।আব্বা আমাকে বলতেন সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে,তাহলে তুমি ও ভালো ব্যবহার পাবে।নিঃসন্দেহে খুব ভালো একটা ম্যাসেজ। আমি এই ম্যাসেজ টা সর্বাত্মক ভাবে গ্রহন করেছিলাম। এবং আমি আমার জীবনে এই নীতিটা কে নিয়ে চলা শুরু করেছিলাম।ভালো ব্যবহার করলে ভালো ব্যবহার পাওয়া হয়তো যায়,কিন্তু এটা চির সত্য না এবং মাঝে মাঝে অন্য কেউ যদি আমার সাথে ক্রমাগত খারাপ ব্যবহার করে তাহলে সে কিন্তু আমার ভালো ব্যবহার টা আশা করে না।আরো একটা ব্যাপার ছিল ছোট বেলায়। আমরা কোথাও না কোথাও এই ম্যাসেজটা পাই সবার সাথে মিলেমিশে থাকাটাই ভালো,মানিয়ে চলাটা বুদ্ধিমানের কাজ।অবশ্যই ভালো ম্যাসেজ।তবে ধীরে ধীরে আমি হয়ে গেলাম পিপল প্লিজার।প্রথম প্রথম আমার কোন অসুবিধা হয় নাই। আমার পরিসর ছিল ছোট,শুধু পরিবার আর আরেকটু বড় হলে স্কুল কলেজের কয়েকজন বন্ধু।বাসার সবাই আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলো।আমি ছিলাম বাসার সবার আদরের। যার ফলে আমি আরো আগ্রহ উতসাহ সহকারে পিপল প্লিজিং কে জীবনের মূলমন্ত্র করে ফেললাম। পরবর্তী তে যা হলো,আমি যখন আস্তে আস্তে পৃথিবীর বড় পরিসরে, আরো বড় স্টেজে পারফর্ম করা শুরু করলাম,তখন মুশকিলে পড়তে লাগলাম। কারন সবাই কে সন্তুষ্ট করা তো সম্ভব না।আমি তো সবার মনের মতো হতে পারবো না।তারচেয়ে বড় কথা,অন্যরা হয়তো অন্যায় করছে,আমি খারাপ ফিল করছি কিন্তু আমি ঠিকমতো কমিউনিকেট করতে পারতাম না।একসময় এমন একটা পর্যায় জীবনে আসলো যখন যেকোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে, যেকোন অসফলতায় আমি নিজে কে দোষী ভাবতাম।একসময় নিজের মাঝেও দ্বিধা তৈরি হতে লাগল।মনের একটা অংশ আস্তে আস্তে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো।তারপর আস্তে আস্তে আমি খিটখিটে হয়ে ওঠলাম,নিজের ওপর কনফিডেন্স হারালাম।কি করে আবার নিজে কে ফিরে পেয়েছি সে কাহিনি তোলা থাক।আমি বরং দেখি আমি আসলে কি করেছি।আমি আমার বাবার ম্যাসেজ টা নিয়েছি এবং প্রাথমিক ভাবে যখন এর সুফল পেয়েছি, তখন আমি ম্যাসেজ টাকে জীবনের পাথেয় করে ফেলেছি।আমি এক ধরনের খাবারই বেশি বেশি আমার সাইকি কে খেতে দিয়েছি।প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কাজটা আমি করেছি না বুঝেই। এভাবেই আমরা আমাদের জীবনের থেকে অনেক কিছু নিয়ে ফেলে সেটাকে মানসিক চাপে পরিনত করি কিছু না বুঝেই। সেকারণেই আমি বলেছি ইমোশনাল টক্সিফিকেশন।মোদ্দা কথা খাবার যেমন আমরা খাই নিজেকে বাচিঁয়ে রাখার জন্য এবং একই সাথে খাদ্যের অপ্রোয়জনীয় অংশ শরীর বের করে দেয়, সেও আমাদের ভালো ভাবে বেচেঁ থাকার জন্য।ঠিক তেমনি ভাবে যেকোন রকম মানসিক খাবার বা উদ্দীপনা আমরা যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই নিচ্ছি নাকি বেশী বেশী নিয়ে সেটাকে মানসিক চাপে পরিনত করছি সেটাই বোঝার বিষয়।আসলে একটা জিনিস বেশি বেশি নিয়ে আমরা নিজেরা ভীষণ টক্সিক হয়ে যাই। তবে সচেতন হলে আমরা আমাদের টক্সিফিকেশন কে ডিটক্সিফাই করতে পারি।দরকার সচেতনতার আর দরকার নিজে কে বদলে ফেলার সাহস।
লেখক: মেডিকেল অফিসার, IEDCR