ঘটনা: সালাম মিয়া কোভিড শেষে হাজী ক্যাম্পের সামনে জিলাপির দোকান দিয়েছে। দেড় বছর করোনাকালীন সময়ে নিজের যা পুঁজি ছিল তাতো শেষ করেছে তার সাথে বউয়ের বিয়ের গয়না বিক্রি করে সংসারটা কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছিল। এখন প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করেও বাড়িতে তেমন টাকা পাঠাতে পারছে না। কারন প্রতিটা কাঁচামালের দাম হু হু করে বাড়ছে। জিলাপির সাইজ ছোট করেছে। কেজি প্রতি দাম কিছুটা বাড়িয়েছে তার পরেও পোষানো যাচ্ছে না । সালাম মিয়াকে হয়তো বেছে নিতে হবে ভেজালের কৌশল। সালাম মিয়ার মতো অনেক ব্যাবসায়ীরা অধিক মুনাফার আসায় বেঁছে নিতে পার মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর রাষায়ানিক দ্রব্য যাকে আমরা খাদ্য দুষণ বা ভেজাল বলি ।
ভেজাল নিয়ে রোকন ভাইয়ের প্রচারনার পর সচেতন নাগরিকরা নানা ধরণের লিখা-লিখি, প্রচার প্রচারণা করেছেন। তবুও খাদ্যদুষণ বা ভেজালের দৈরাত্ব্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেন এই দৈরাত্ব্য? কী আছে এর পেছনের শক্তি? শহরবাসীদের পাশাপাশি গ্রামবাসীরাওÍ ভেজাল দিয়ে গ্রাসিত। গ্রাসিত গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও কিডনির জটিল সব রোগে। একদিকে নামি দামি হাসপাতাল অপর দিকে নামি দামি সকল হোটেলে খাদ্য দুষন বা ভেজাল দিয়ে ছেয়ে গিয়েছে। এ যেন হবু চন্দ্রের দেশ।দেখার কেউ নেই। যে যেভাবে পারে ভেজাল দিয়ে খাদ্য দুষণ করে পয়সা বানানোর চেষ্টা করছে। পয়সা খুব একটা হচ্ছে তা নয়। ভেজাল মেশানো হচ্ছে খাবারেরা কাঁচামালেও। ফলে ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে তৈরি খাবারে।
তৈরী ভেজাল খাবার হলো সেই সমস্ত খাবার যা তৈরী করা হয় রাষায়নিক উপাদান দিয়ে যা মানুষের শরীরের জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি সৃস্টি করে। ভেজাল খাবার নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উদ্বিগ্নতার কারন শুরু হয়েছে বহু বছর আগে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে পরোক্ষভাবে ভেজাল খাবার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাকিস্থান আমল থেকেই এদেশে মারোয়ারী ব্যবসায়ীদের পণ্যে ভেজাল প্রবনতা দেখা দেয়। বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গ বা দক্ষিন অঞ্চল যতটানা ভেজাল খাবার নিয়ে বিব্রত তার থেকে সিলেট-কুমিল্লা – চট্রগ্রামের অধিবাসিরা ভেজাল খাবার নিয়ে অধিক বিব্রত। এই কারনে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ঐ সকল অঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হয়। কতৃপক্ষের উদাসীনতা ও আইনের স্বল্পতার কারনে দিন দিন বেড়েই চলেছে ভেজাল খাবারের দৌরাত্ব । ভেজাল খাবার তৈরীর জন্য কি কি উপাদান লাগে এবং ভেজাল উপাদান মানব শরীরের জন্য কি কি ক্ষতি হয় তার সংক্ষিপ্ত বর্ননা দেয়া হলো।
১. বিরিয়ানী। ভেজাল উপকরনঃ ডালাডা (মুলত: লার্ড)। বিবরনঃ বিরানি বা আখনিতে মেশানো হয় ডালডা নামের পশুর চর্বি। আমরা কেউ জানি না কোন জাতের পশু। সাদা বড় বড় দলা আকৃতির চর্বি আনা হয় পুরান ঢাকার পাইকারী মার্কেট থেকে। সাদা দলাকে ডালডা বলা হয়। আসলে তা ডালডা নয়। বিশেষজ্ঞ মতে ডালডা নামক এই চর্বি লার্ড হিসেবে আমদানী করা হয় সাবানে ব্যবহার করার জন্য। শুকরের চর্বিকে লার্ড বলা হয়। বাটার ওয়েল বলে যা পাওয়া যায় তা এই লার্ডের নামান্তর। যার ফলে বিভিন্ন হোটেলে আখনি, পরাটা খেলে মুখে আঠা আঠা লাগে। বিদেশে লার্ড ব্যবহার করা হয় খাদ্যকে মচমচে ও নরম রাখার জন্য, যা এখন নিষিদ্ধ। লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন হোটেলের পরাটা ঠান্ডা হলেও তা নরম থাকে। ক্ষতিঃ খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে গলাতে প্রদাহ শুরু হয় বা গ্যাস নির্গত হয়। অনেকে অসস্থি থেকে রক্ষা পাবার জন্য পান-পাতা খেয়ে থাকেন । কেউ কেউ বমি করেন।
২. কাবাব। ভেজাল উপকরনঃ কাপড়ের রং। বিবরনঃ সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন দোকানে কাবাব বলে বিক্রি হয় রং করা ঝলসানো মাংস। এই কাবাব খেলে কারো কারো প্রসাব রংঙ্গিন হবার অভিযোগ পাওয়া যায় । রং গুলো টেক্সটাইল ডাইং বলে বহুল পরিচিত। ক্ষতিঃ রং করা কাবাব কিডনির, মুত্রথলি, মস্তিস্ক প্রভৃতির জন্য ক্ষতিকর। এই ক্ষতি তাৎক্ষনিকভাবে বোঝা যায় না ।
৩. কন্ডেন্স মিল্ক। ভেজাল উপকরনঃ পামওয়েল, সাদা পাউডার। বিবরনঃ কন্ডেন্স মিল্ক তৈরী করা খুব সহজ। পামওয়েল, চিনি, এরারুট জাতীয় সাদা পাউডার, পানি প্রভৃতি একসাথে মিশিয়ে দিলে তা কন্ডেন্স মিল্ক হবে। ফলে কন্ডেন্স মিল্ক খুব মিস্টি এবং এর তৈরী চা খাওয়ার পর গলাতে জ্বালাপোড়া করে। গ্যাস্ট্রিক তৈরীতে সহায়তা করে। ক্ষতিঃ কিডনি পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য শুধু কন্ডেন্স মিল্কই যথেষ্ট । এছাড়া আলসার তৈরীতে এর জুড়ি মেলা ভার।
৪. জুস। ভেজাল উপকরনঃ রং, সেকারিন, পিজারভেটিভ সেন্ট, এরারুটের পানি (ম্যাংগো জুসের তৈরীর উপকরন)। বিবরনঃ বিভিন্ন প্রকার জুস বিশেষ করে ম্যাংগো জুস-এর প্রাণ কারা বিজ্ঞাপন দেখে সমাজের এলিট ব্যাক্তিরা মজা করে তা খায়। মনে রাখবেন, কোনভাবেই ফলের রস বোতলে মজুত করা যায় না। কিছুদিন আগে ডিসকোভারি চ্যানেলে দেখায়, ফল বা ফলের রস মজুদ রাখার জন্য প্রাচীন কালের রাজা-বাদশারা হাজারো রকমের চেষ্টা করেছেন। ফলের রস কোনভাবেই সংরক্ষন করা যায় নাই। বাজারে জুস দেশি বা বিদেশী বলে প্রচলিত তা সবই কেমিক্যাল । যেমন ম্যাংগো জুস আম ছাড়াই তৈরী হয়। ক্ষতিঃ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কৃত্রিম রং সরাসরি মুত্র থলিতে ঘা তৈরী, রক্তদুষিত ও কিডনি ড্যামেজ করে।
৫. ড্রিংস। ভেজাল উপকরনঃ কেমিক্যাল, চিনি ও পানি। বিবরনঃ বাসায় অতিথি এলে একসময় দেয়া হতো হাতে বানানো নারু আর ঠান্ডা একগ্লাস পানি। এখন দেয়া হয় ড্রিংস। ড্রিংসের ব্যাবহার এখন ব্যাপক। বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা, চাইনিজ রেস্তোরা, বিয়ে,পুজা, ঈদ, সব স্থানে স্থান করে নিয়েছে ড্রিংস । ড্রিংসের ব্যাবহারের ব্যাপকতা দেখে বাজারে বহু চেনা-অচেনা কোম্পানি ড্রিংস ব্যাবসাতে নেমেছেন। ক্ষতিঃ কিডনি ও মুত্র থলি নষ্ট হয়। পাশাপাশি এর প্রভাবে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার দেখা দিতে পারে। পাকস্থলিতে ঘা তৈরী হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
৬. পরটা। ভেজাল উপকরনঃ পাম ওয়েল, খনিজ ওয়েল, ও ডালডা নামক পশুর চর্বি। বিবরনঃ পরটাতে মেশানো হয় ডালডা নামের পশুর চর্বি যা পরাটাকে নরম রাখে। ক্ষতিঃ গ্যস্ট্রিক ও আলসার
৭. জিলাপি । ভেজাল উপকরনঃ ডালাডা (মুলত: লার্ড), খনিজ তৈল যা মবিল বলে পরিচিত। বিবরনঃ জিলাপিতে ব্যবহার করা হয় ডালডা । ডালডার ক্ষতি সমন্ধে আগেই বলা হয়েছে । ডালডা একধরনের পশুর চর্বি। বিশেষজ্ঞ মতে, ডালডা নামক এই চর্বি লার্ড হিসেবে আমদানী করা হয় সাবানে ব্যবহার করার জন্য। শুকরের চর্বিকে লার্ড বলা হয়। বাটার ওয়েল বলে যা পাওয়া যায় তা সবটাই লার্ড। লার্ড মেশানো জিলাপি খাওয়ার পর মুখে আটা আটা লাগবে। ক্ষতিঃ অন্ত্রে প্রদাহ, গ্যাস্ট্রিক।
৮. সোয়াবিন তেল ও সরিষার তৈল। ভেজাল উপকরনঃ খনিজ তৈল, পামওয়েল, সেলিসাইলিক এসিড,পোড়া মোবিল। বিবরনঃ সোয়াবিন তেল বলে বিক্রি করা হয় পামওয়েল । যা উন্নতমানের সাবানের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সরিষার তৈল বানানোর জন্য ভেজাল বিক্রেতারা ব্যাবহার করেন সেলিসাইলিক এসিড। কখনও শুকনা মরিচের ঝাল মিশিয়ে সরিষার তেলে ঝাঝ তৈরী করা হয়। অধিকাংশ হোটেলে নিম্নমানের সয়াবিন তেল বলে কিনে আনে যে তেল তা মুলত: পামওয়েল। ফলে হোটেলের খাবার খেয়ে পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। দেশের হাই ডেকোরেশন করা হোটেল সহ সকল নামি-দামি হোটেলে ব্যবহার করা হয় ভেজাল সোয়াবিন তেল । তৈরী খাদ্য গ্রাহকদের জন্য এটা খুব সমস্যা । তাদের কোন বিকল্প পথ নেই এই সব খাদ্য নামক বিষের কবল থেকে রক্ষা পাবার। ক্ষতিঃ খাদ্য মানেই পেট সংক্রান্ত বিষয়। তাই খাদ্য ভেজাল হলে পেটই প্রথমে আঘাত পায়। ভেজাল তেল খেলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হবেই।
৯. টমেটু সস । ভেজাল উপকরনঃ মিস্টি কুমড়া, তেতুল, পানি, কাপড়ের রং। বিবরনঃ অধিকাংশ সস বানানো হয় পাকা মিষ্টিকুমড়া, আটা ও কাপড়ের রং দিয়ে যা খাওয়ার পর পাকস্থলিতে প্রদাহ তৈরী করে। ইদানিং সস বানানো হয় এরারুট বা ভুট্টার আটার সাথে চিনি ও কাপড়েরর রং মিশিয়ে। ক্ষতিঃ গ্যস্ট্রিক ও আলসার।
১০. দুধ। ভেজাল উপকরনঃ পাউডার দুধ ও দুধের সেন্ট। বিবরনঃ বাজারে পাওয়া অধিকাংশ দুধ পাউডার কেমিক্যাল ও দুধের সেন্ট মেশানো। দুধ কোম্পানিগুলো ঠিক এই প্রক্রিয়াতে দুধ বানিয়ে সাধারন মানুষের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কষ্টাজর্তিত অর্থ। নামি দুধ কোম্পানিগুলোর দুধ স্থান বিশেষে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। দেশের প্রধান প্রধান শহরের যে মানের দুধ পাওয়া যায় তা অন্যঅঞ্চলের দুধের সাথে পার্থক্য। দুধের মুল উপাদান হলো ফ্যাট, সুগার ও পানি। শাহজাদপুর সহ দেশের দুধ প্রদানকারী অঞ্চলে দুধ তৈরী করা হয় ১০% আসল দুধের সাথে পরিমানমত খাবারের সোডা, সরিষার তেল, গুড় মিশিয়ে। রেডিসনের মত বড় বড় হোটেলে ভেজাল খাবার ডিটেকশন মেশিনে দুধের ভেজাল ধরা যায় না। পত্রিকার তথ্য মতে, আমাদের দেশে যে সব দুধ পাওয়া যায় তার অধিকাংশ তৈরী হয় বাতিল হওয়া পাউডার মিল্কের গুড়ো থেকে। বিদেশে পাউডার মিল্ক বাতিল হলে তার বড় গর্ত করে মাটিতে পুতে ফেলতে হয়। সাগরেও ফেলা যায় না। সাগর দুষন হবে বলে। টনকে টন দুধ মাটির গর্তে পুতে ফেলে। দুধ গর্তে ফেলার পর তা পাথর হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা এই পাথর সংগ্রহ করে বাংলাদেশের আনে এবং তা মেশিন দিয়ে ভেঙ্গে মার্কেটে নানা বিজ্ঞাপন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ক্ষতিঃ গ্যস্ট্রিক ও আলসার।
১১. ঘি। ভেজাল উপকরনঃ ডালডা, মেথির গুড়ো, সয়াবিন তেল ও ঘির কেমিকেল সেন্ট। বর্তমানে একধরনের ফলের নির্জাস থেকেও ঘি বানানো হয়। বিবরনঃ বাজারের অধিকাংশ ঘি বানানোর প্রক্রিয়া একই। গরু দুধ ছাড়া ঘি তৈরী হয়। ক্ষতিঃ গ্যস্ট্রিক ও আলসার।
১২. মিস্টি। ভেজাল উপকরনঃ এরারুট বা চাউলের গুড়ো, আটা। বিবরনঃ অধিকাংশ মিস্টি বানানো হয় চাউলের গুড়া ও ময়লা আটা দিয়ে। আটাকে সাদা করার জন্য মিস্টিতে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজ যা কিনা মানব শরীরের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। ক্ষতিঃ গ্যস্ট্রিক ও আলসার।
১৩. দৈ। ভেজাল উপকরন- চাইনিজ মাখনের পানি (ছানার পানি), ক্যামিক্যাল, টিসু পেপার, ক্যামিক্যাল চিনি।
১৪. মসলা। ভেজাল উপকরনঃ কাঠ বা ঘাসের গুড়ো। বিবরনঃ কাঠের বা ঘাসের গুড়ো মিশিয়ে মসলা তৈরী করা আমাদের দেশের বহু বছর আগের ঐতিহ্য। ইটের গুড়ো ব্যবহার করা হতো মসলাতে। বাংলাদেশের গৃহীনিরা/রাধুনিরা মনে করে মসলা দিলেই খাবার সু-স্বাদু ও পুষ্টিকর হয়। তাই তারা রাধুনীদের জন্য মসলা প্যাকেটে করে পৌছে দেয়। এক সময় ছিল যখন টাইগার ব্রান্ডের মসলা পাওয়া যেত। প্রায়ঃশ ইটের গুড়ো পাওয়া যেত সেই সকল মশলা থেকে। এখনতো নামি দামি কোম্পানিরা মসলা বিক্রিতে নেমেছে। ক্ষতিঃ অতিরিক্ত বা ভেজাল মসলা গ্যস্ট্রিক ও আলসার হতে সহায়তা করে।
১৫. বিস্কিট। ভেজাল উপকরনঃ নিম্নমানের আটা, ডালডা নামক চর্বি, এমোনিয়া। বিবরনঃ আমাদের দেশের অধিকাংশ বিস্টিক খেলে মুখের ভেতরে দাতে, খাদ্য নালীতে আঠার মত চর্বি লেগে থাকে। কারো কারো বিস্কিট খাওয়ার পর পর গলনালীতে জ্বালা পোড়া করতে থাকে । এর কারন আমাদের দেশের অধিকাংশ বিস্কিটে বিশুদ্ধ তেলের পরিবর্তে ডালডা নামক পশুর চর্বি মেশানো হয়। ক্ষতিঃ ভেজাল বিস্কিট খেলে পাকস্থলির সমস্যা যেমন – আলসার, গ্যাস্ট্রিক প্রভৃতি হতে পারে।
১৬. বন বা পাউরুটি। ভেজাল উপকরনঃ নিম্নমানের আটা, এমোনিয়া । বিবরনঃ নিম্নমানের আটার সাথে ভেজাল এমোনিয়া দিয়ে পাউরুটি তৈরী করে। ক্ষতিঃ এধরনের পাউরুটিতে গ্যস্ট্রিক ও আলসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
১৭. শুটকি মাছ। ভেজাল উপকরনঃ শুটকি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছুরি, লইট্যা, ভেটকি, চিংড়ি, পাইস্যা, রূপচাঁদা, লাক্ষা জাতীয় মাছ ছাড়াও মৃত্যুঝুঁকিসম্পন্ন পটকা মাছও রৌদ্রে শুকিয়ে শুটকি করে থাকে। বছরে কয়েক কোটি টাকার শুটকি প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এগুলো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রক্রিয়াজাতকরণের পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, কীটনাশক (বিষ)। যেগুলোর মধ্যে সবিক্রন, লিডার, ম্যাপন, কট্, টিডো, এডমায়ার, ইমিটাপ ও অটোচার্চসহ বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। খোলা জায়গায় এসব বিষাক্ত পদার্থ (বিষ) ব্যবহারের ফলে এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা অজান্তে দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে শুটকির উৎপাদিত প্রতিষ্ঠানগুলো জনবহুল এলাকায় সাধারণের যাতায়াতের রাস্তার পাশে হওয়ায় মানুষেরও ভোগান্তির শেষ নেই। বিবরনঃ কেউ কেউ শখ করে শুটকি কিনে খাচ্ছে। ভোজন রসিকদের রসনার একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে শুটকি। এই শুটকি খাওয়ার ফলে রোগ-ব্যাধি বাড়ছে। উৎপাদিত শুটকিতে দেয়া হচ্ছে বিষ জাতীয় কীটনাশক। কীটনাশকগুলো মানব শরীরে গেলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষতিঃ বিশেষজ্ঞদের মতে।। সাইপার-মেথ্রিন, প্রোফেনোফেস, ডাইমিথানলসাই-ক্লোপ্রোপেন জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাতকৃত শুটকি খেলে দীর্ঘমেয়াদী স্নায়ু সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার ও কিডনি নষ্ট হওয়সহ প্রাণঘাতী নানান রোগ হতে পারে। তাই এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ক্ষতিকারক উপাদান এক নজরে:
লার্ড, হাইড্রোজ, টেস্টিং সল্ট, পাম ওয়েল, ফরমালিন, র্কাবাইড, খনিজ তৈল, মবিল, রং, ইউরিয়া, এ্যামোনিয়া, ক্যাডিয়াম, কাঠের গুড়ো, ঘাসের গুড়ো। টেস্টিং সল্ট এটা একটা অপ্রয়োজনীয় এমিনো এসিড। জাপানের গবেষক চিসাতো নাগাতা ও তার সহকর্মী দল গবেষণাতে দেখেন, ১৯৯২-১৯৯৯ পর্যন্ত ২৬৯ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত রুগীর মধ্যে অধিকাংশরাই টেস্টিং সল্ট বা মনোসোডিয়াম সল্ট ব্যাবহার করতো। আজিনোমোতো হলো সাদা রং-এর লবন যাতে ইউমামি এসিড মনোসোডিয়ামের সাথে মিশিয়ে বাজার জাত করা হয়। টেস্টিং সল্ট ৬০% গ্যস্ট্রিক তৈরী হতে সহায়তা করে। চিকন লবন বা রিফাইন সল্ট
ভেজাল স্তর: কাঁচামাল তৈরী, পাকা মাল তৈরী, প্রস্তুতকৃত খাবার, বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন, বিক্রেতা ।
ভেজাল বা খাদ্য দুষণ সুরু হয় খাবারের কাঁচামাল তৈরী থেকে। কৃষকের চাষের সময় রাষায়নিক দ্রব্য মেশানো হলো এর শুরু। এর পর সেই কাঁচা মাল সংরক্ষন করার জন্য রাষায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে বাজার জাত করা হয়। এর পর হোটেলগুলো যখন খাবার তৈরী করে তখন ৩য় স্তরের খাদ্য দুষণ হয় ও মানুষ তা দাম দিয়ে ক্রয় করে।
ভেজাল প্রতিরোধে সরকারী পদক্ষেপঃ
সরকার ভেজাল প্রতিরোধের জন্য এযাবৎ বেশ কয়েকটি আইন তৈরী করেছে যথা ঃ দন্ডবিধি-১৮৬০, বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯, খাদ্য নিরাপত্তা আইন-২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫ ।
দন্ডবিধি-১৮৬০
দন্ড বিধি ২৭২ নং ধারায় বলা হয়েছে যে ক্ষতিকর কোনও খাবার বা পানীয়ের কোনও বিক্রি বা বিক্রি করার করার ইচ্ছা পোষণ করলে ছয় মাসের কারাদন্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন
এই আইনের ২৫ (গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্য ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশঅলে বা ভেজাল খাদ্য বা ঔষধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রর্দশন করার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান আছে (এই আইনের আওতায় কারো শাস্তির নজির নাই)।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন -২০০৯
এই আইনটির ৪১নং ধারাতে বলা হয়েছে ” কোন ব্যাক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ করিলে বা বিক্রয় করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনুর্ধ্ব তিন বৎসরের কারা দন্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। আবার ভোক্তারা যেন কোন প্রকার মামলা না করে সে জন্য একই আইনের ৫৪ নং ধারাতে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি কোন ব্যবসায়ী বা সেবা প্রদানকারীকে হয়রানি বা জনসমক্ষে হেয় করা বা তাহার ব্যবসায়িক ক্ষতি সাধনের অভিপ্রায়ে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করিলে, উক্ত ব্যক্তি অনূর্ধ্ব তিন বৎসরের কারাদন্ডম বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩
এই আইন তফসিল (ধারা ৫৮ মতে) বলা হয়েছে – মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা উহার উপাদান বা বস্তু, কীটনাশক বা বালাইনাশক, খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি বা অন্য কোন বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্তি অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় এর ক্ষেত্রে প্রথমবার অপরাধ সংঘটনের জন্য আরোপযোগ্য দন্ড – অনূর্ধ্ব পাঁচ বৎসর কিন্তু অন্যূন চার বৎসর কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব দশ লক্ষ টাকা কিন্তু অন্যূন পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ড । পুনরায় একই অপরাধ সংঘটনের জন্য আরোপযোগ্য দন্ড – পাঁচ বৎসর কারাদন্ড বা বিশ লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ড।
এছাড়া ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ প্রস্তুত, পরিবেশন বা বিক্রয় এর জন্য অনূর্ধ্ব দুই বৎসর কিন্তু অন্যূন এক বৎসর কারাদÐ বা অনধিক চার লক্ষ টাকা কিন্তু অন্যূন দুই লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ড । দুই বৎসর কারা দন্ড বা আট লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ড ।
ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫
কোন ব্যাক্তি যদি এই আইনের অধীন প্রদত্ত লাইসেন্সের কোন শর্ত ভঙ্গ করেন (মানব দেহের ক্ষতি হয় এমন খাবারে ফরমালিন ব্যবাহার করে), তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অপরাধমূলক কাজের জন্য ৭ (সাত) বৎসরের কারাদন্ড ও দুই লক্ষ টাকা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
কয়েক বছর আগে, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলনে, ভজোল প্রতরিোধে প্রয়োজনে নিরাপদ খাদ্য আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডরে বধিান রাখা হবে৷ এরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসমি খাদ্যে ভজোলকারী অসাধু ব্যবসায়ীদরে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দাবি জানান৷ তিনি বলনে,‘ ভজোলকারীদরে অপরাধ একাত্তররে ঘাতকদরে চেয়েও কম নয়’৷
একদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল ডয়েচ ভেলে কে বলনে,‘খাদ্যে ভজোলরে অপরাধে যারা মৃত্যুদণ্ড চান তারা এখনো আমাদরে কাছে কোনো প্রস্তাব দেননি ৷ তারা আগে প্রস্তাব দিক তারপর আমরা দখেবো ৷ তিনি বলনে, ‘তবে মৃত্যুদণ্ডরে বিধান করলে কোনো আসামি যদি বিদেশে পালিয়ে যায় এবং তার মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে তাকে সারাজীবনে আর দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না৷ কারণ সারা বিশ্বে দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ডরে বরিুদ্ধে জনমত প্রবল হচ্ছে । কোনো কোনো দশে এরইমধ্যে মৃত্যুদণ্ডরে বিধান রোহিত করেছে নতুন আইন করলে এটা আমাদরে ববিচেনায় রাখতে হবে।
আইন থাকলে কি হবে জনগন যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না মনে করে, তারা যদি ক্রাইমকে স্বাদরে গ্রহন করে তাহলে সরকারের কিছুই করার থাকে না। অধিকাংশ জনগন মনে করছে না ভেজাল খাবার বা খাদ্য দূষণ একটি অপরাধ। খাদ্যে যতই ভেজাল দিক যতক্ষণ পর্যন্ত জনগন অপরাধ মনে না করে ততক্ষণ এটা বন্ধের সম্ভাবনা কম।
ভেজাল খাবার প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে একটাই ও একমাত্র সমাধান খাদ্যে ভেজাল দেয়া হলো অপরাধ ও এর কারনে ভেজালকারীকে মৃত্যদন্ড বিধান চালু করা। মহামান্য রাস্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রি আপনারা যদি বাংলাদেশের ভাল চান, যদি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের সোনার মানুষদের মঙ্গল চান তাহলে তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় এগিয়ে আসুন। জনগনকে ভেজাল খাবার থেকে রক্ষা করুন। শুধুমাত্র আপনাদের খাবার ভেজালমুক্ত রাখবেন জনগনের খাবার ভেজালমুক্ত রাখবেন না এটা কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ব্যাহত হচ্ছে না? তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ ভেজাল প্রদানের অপরাধে ভেজালকারীকে মৃত্যুদন্ড দন্ডিত করার জন্য আইনের যথাযথ সংস্করন করুন দয়াকরে।
– কাজী মাহমুদুর রহমান
২৭১ নদ্দাপাড়া, দক্ষিনখান, ঢাকা
০১৯১৪০০৯৯৪৭